ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

বিদ্রোহ দমনে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ছিল দূরদর্শিতাপূর্ণ

ইলিয়াস সরকার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০২০
বিদ্রোহ দমনে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ছিল দূরদর্শিতাপূর্ণ হাইকোর্ট। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসীম ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও  সাহসিকতার সঙ্গে দৃঢ় মনোবল নিয়ে শক্ত হাতে বিডিআর বিদ্রোহ দমনে যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত ছিল দূরদর্শিতাপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বুধবার হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী।

তিন বিচারপতির দেওয়া ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার মধ্যে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ১১ হাজার ৪০৮ থেকে ২৭ হাজার ৯৫৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখেছেন।

তার রায়ে মামলার প্রেক্ষাপট, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও নৃশংসতার সচিত্র পর্যবেক্ষণ, প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক আইনের প্রয়োগ ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের সঙ্গে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার একমত পোষণ করেছেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিদ্রোহ দমনে সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করে বলা হয়, বিডিআর বিদ্রোহের ভয়াবহতা ও আকস্মিকতায় সদ্য নির্বাচিত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসীম ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সাথে দৃঢ় মনোবল নিয়ে শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমনের যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত ছিল দূরদর্শিতাপূর্ণ।

বাংলাদেশ রাইফেলসের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নের লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসের চক্রান্ত রুখে দেয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রনায়কোচিতভাবে তার গৃহীত পদক্ষেপ ছিল সময়োপযোগী। পাশাপাশি আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রশিক্ষিত ও সুশৃংঙ্খল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনী দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অবিচল আস্থা রেখে চরম ধৈর্যের সাথে উদ্ভূত ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবেলার মাধ্যমে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে সমগ্র দেশবাসীর ভালোবাসা ও সুনাম অর্জন করেছেন।

পর্যবেক্ষণে এ বিচারপতি কয়েকটি বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ রাইফেলসের নিরাপত্তা বিষয়ক ইউনিট আরএসইউ বিজিবির মেধাবী, সৎ ও চৌকস সদস্যের সমন্বয়ে নুতনভাবে ঢেলে সাজানো এবং ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে দায়িত্বে অবহেলার জন্যে ঘটনাকালীন সময়ে দায়িত্বে থাকা আরএসইউয়ের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ওইদিন সশস্ত্র আক্রমণ এবং পিলখানায় মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পূর্বাভাস সংগ্রহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাসহ দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

প্রধানমন্ত্রী ঘটনার দিন পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলসের কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেছেন, অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ঠ গোয়েন্দা বাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীদের বাহ্যিক তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও ভেতরে অন্তঃসার শূন্যতা পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অধিকতর সতর্ক করা।

বিডিআরে তীব্র অসন্তোষ এবং প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাসহ কমান্ডিং অফিসারদের নজরে আসা সত্ত্বেও তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ গ্রহণ না করে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য সংশ্লিষ্টদের মনযোগী ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ।

মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মেধাবী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দক্ষ, তড়িৎ ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী, উপযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিজিবির মহা-পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগের কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বিজিবির অফিসারসহ সকল পদের সদস্যদের মানবিক গুণাবলী, দায়িত্ব, কর্তব্য, বিভাগীয় আইন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কিত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

সামরিক/বেসামরিক সকল শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ব্রিটিশ আমলের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে সকলকে সেবার মানসিকতা নিয়ে দেশ প্রেমের সঙ্গে কাজ করার প্রশিক্ষণ প্রদান করা।

৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রামে, পেশা, পদবী, সামাজিক পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সংবিধানে উল্লেখিত মূলনীতি অনুসরণ করে সকলের প্রতি মানবিক আচরণ ও সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতায় বাহিনীকে গড়ে তোলা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিজিবিসহ অধীস্থ সকল বাহিনীর সদস্যদের সুবিধা/অসুবিধা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সাথে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির পূর্বেই কর্তৃপক্ষকে আইন সম্মত ও সম্মানজনক উপায়ে তার সমাধান খুঁজে বের করা।

বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে চাকরি বিধি মতে মর্যাদার পার্থক্য যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা এবং সকলকে সংবিধান সম্মত উপায়ে আইনানুগভাবে সম্মানের সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের চাকরি করার সুযোগ সৃষ্টি করা।

বিজিবির সদস্যদের পদোন্নতি, বেতন, ভাতা, রেশন, ছুটি, আবাসিক সমস্যা, চিকিৎসা ও সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের সুবিধাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উদ্ভুত সমস্যা দ্রুত সমাধানে মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আইনানুগ কোনো বাধা না থাকলে অন্যান্য বাহিনীর ন্যায় বিজিবির সদস্যদের জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশ গ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের প্রতি সম-আচরণ করা। দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার কর্তৃক অধীনস্থদের প্রতি আত্মমর্যাদা হানিকর যে কোন আচরণ থেকে বিরত থাকা, কারণ তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী।

পিলখানায় নিহত সামরিক, আধা-সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।

সেনা কর্মকর্তাসহ নিহতদের সন্তান বা পরিবারের উপযুক্ত সদস্যদের আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা বিধানে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

সামরিক কর্মকর্তাসহ নিহতদের সম্মানে পিলখানাসহ দেশের সকল সেনানিবাস, বিজিবির সকল সেক্টর হেড কোয়ার্টারে নাম ফলক নির্মাণ করা।

পুনর্গঠিত বিজিবি সংবিধান ও নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে দেশের সীমান্ত রক্ষাসহ তাদের ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব পেশাদার বাহিনী হিসাবে দেশ-প্রেম, সততা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে পালনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিজিবির হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা।

দেশের সীমান্তরক্ষী হিসাবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রাথমিক নিরাপত্তা বাহিনীর (First Defence Force) দায়িত্বে থাকা বিজিবিকে শক্তিশালী বাহিনীরুপে গড়ে তোলার কার্যকারী পদক্ষপ গ্রহণ করা।

সেনা বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীকে 'অপারেশন ডাল ভাতের ন্যায় অন্য কোন আর্থিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত পরিহার করা। আর্থিক লেনদেন ও লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের মধ্যে অহেতুক বিভেদ ও নৈতিক স্খলনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ রাইফেলসের ক্ষেত্রে 'অপারেশন ডালভাত উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডে 'ঘটনার পিছনের ঘটনা' উৎঘাটন করে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্যে জনস্বার্থে সরকার প্রয়োজন মনে করলে আইনানুগভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

সমাজের স্তরে নৈতিকতা পুনরুদ্ধার ও জাতিগঠনের জন্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষায় বাধ্যতামূলক নীতিশাস্ত্র (Ethics) শিক্ষাদান অতি জরুরি। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজের প্রতিটি স্তরে অসম প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় নীতিশাস্ত্রের (Ethics) অধ্যায়ন বাধ্যতামূলক হওয়া অপরিহার্য।  

রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বসবাস উপযোগী উন্নত ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে নিজ নিজ ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুশাসনে শিশুদের চরিত্র গঠনের মাধ্যমে মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার বিশুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্যে অত্যন্ত জরুরি।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২০
ইএস/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।