ঢাকা: পিলখানা ট্রাজেডির ১৩ বছর পূর্ণ হতে চলছে। বিদ্রোহের ওই ঘটনায় বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি ৮৫০ জন বিডিআর সদস্যকে ফৌজদারি আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
তবে ১৩ বছরেও এই ঘটনায় হওয়া বিস্ফোরক মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণে অগ্রগতি না হওয়ায় এই ৪৬৮ বিডিআর সদস্য মুক্তি পাচ্ছেন না। সেসব পরিবারের পক্ষ থেকে রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) পুরান ঢাকার জেলা জজ আদালত সংলগ্ন কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিডিআরের ৪৬৮ সদস্যের মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
এসব পরিবারের পক্ষে কারাবন্দি বিডিআর সদস্য মুসার ভাই মো. ওয়ারেছ লিখিত বক্তব্য দেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বিভাগীয় মামলা শেষ হয় ২০১১ সালে। এরপর হত্যা মামলাটি ৬৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে দুই বছর ১১ মাসের মধ্যে সব আইনি কার্যক্রম শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় প্রদান করেন।
ওই মামলা উচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তি হয় ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর, যা বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। অথচ একইসঙ্গে হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার গেজেট হওয়া সত্ত্বেও বিস্ফোরক মামলাটি কোনো এক অদৃশ্য কারণে আলাদা করা হয়, যা এখনো নিম্ন আদালতে বিচারাধীন। এই মামলায় প্রাথমিক অবস্থায় ২০১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিমাসে দুই দিন ধার্য থাকলেও নামমাত্র এক ঘণ্টা কোর্ট চলে।
মামলায় সাজা শেষ হওয়া আসামিদের প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আদালত থেকে হত্যা মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পাওয়া ২৭৮ জন। এছাড়া স্বল্পমেয়াদী সাজাভোগ শেষ করা ১৯০ জন বিডিআর সদস্য রয়েছেন। সবমিলিয়ে ৪৬৮ জন বিডিআর সদস্য মুক্তির প্রহর গুনছেন। কিন্তু একই ঘটনায় বিস্ফোরক মামলার কারণে খালাসপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা মুক্তি পাচ্ছেন না। এমনকি মামলা নিষ্পত্তি করা হচ্ছে না ও জামিন দেওয়া হচ্ছে না।
এ অবস্থায় সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আমরা অসহায় পরিবারগুলো প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। কারণ ভুক্তভোগী পরিবার যেমনি ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে, তেমনি আমরা আসামির পরিবারগুলো ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি। একজন বন্দির সব আইনি সুযোগ-সুবিধাসহ ন্যায়বিচার করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা সব আইনি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
হত্যা মামলায় খালাস বা সাজা শেষ হলেও বিস্ফোরক মামলায় উচ্চ আদালতে জামিনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়। পরিবারগুলোর পক্ষে মো. ওয়ারেছ বলেন, বিস্ফোরক মামলায় দীর্ঘ ১৩ বছরেও আমাদের জামিন দেওয়া হচ্ছে না। এই মামলায় বারবার নিম্ন আদালতে জামিন চাইলে না দিয়ে উল্টো জামিন নামঞ্জুরের কপি সরবরাহ করা হচ্ছে না। আমাদের উচ্চ আদালতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ না করায় আমরা উচ্চ আদালতে যেতে পারছি না।
সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে এসব সদস্যদের অবদান স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কারও বাবা, কারও ভাই, কারও স্বামী-সন্তান দীর্ঘকাল দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। একেকজন একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। অথচ একটি দুর্ঘটনায় সেই ব্যক্তি কারাগারে অবরুদ্ধ হওয়ার কারণে পরিবারগুলোর করুণ অসহায় অবস্থায় দীর্ঘ বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এমনিভাবে শত শত পরিবার একদিকে নির্মম নিঃসহায় দিনযাপন করছে, অন্যদিকে কারাগারে আটক প্রিয় স্বজনদের খরচ, আইনজীবদের খরচ, পরিবার পরিচালনা করা অতিশয় কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছে। অথচ বিষয়টি কোনো মহলের নজরে আসছে না।
তাছাড়া হত্যা মামলায়ও আপিলের রায়ের কাগজপত্র কারাগারে পাঠানো হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, উচ্চ আদালত থেকে ২০১৭ সালে হত্যা মামলার আপিল নিষ্পত্তি বা রায় হয়। কিন্তু ৪ বছরের বেশি সময় পার হলেও অদ্যবধি কোনো কাগজপত্র কারাগারে পৌঁছায়নি। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা তাদের বার্ষিক রেয়াত থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকের সাজা কমেছে এবং জরিমানা মওকুফ করা হয়েছে, তা-ও জানতে পারছেন না।
কারাগারে এসব বিডিআর সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কারান্তরীণ বিডিআরদের অনেকে বয়সের কারণে চলাচল করতে অক্ষম হয়ে নিদারুণ কষ্টে ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করছেন। ইতোমধ্যে নানা রোগে শোকে কারাগারে ৪২ জন মৃত্যুবরণ করেছে এবং আরও অনেকে জিজ্ঞাসাবাদে নানারকম অত্যাচারে পঙ্গুত্বের সঙ্গে দিনাতিপাত করছেন। দীর্ঘদিন বিচারবহির্ভূত আটক থাকায় রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে কারাবন্দি বিডিআর সদস্যদের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ, বিডিআর সদস্য আব্দুর রশীদের ছেলে সাকিব আহম্মেদ, আব্দুস সালামের স্ত্রী আঞ্জুমানারা ও ছেলে অনিক, ঝাড়ুদার আইনুলের স্ত্রী এবং বিডিআর সদস্য রাখালের স্ত্রী রহিমা খাতুন উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২২
কেআই/জেএইচটি