গাড়ি ভাঙলো মানেই সে তা অপছন্দ করলো তা নয়। যে গাড়িটি তার চোখের সামনে দিয়ে ছুটে চলে সাঁ সাঁ গতিতে, সেই বেগবান গতির বিস্ময় তাকে ভাবায়।
সব শিশুর আগ্রহ আর সৃজনশীলতা এক নয়। কোনো শিশু কারিগারি বিষয় নিয়ে আগ্রহ দেখায়, কেউ মাটি নিয়ে খেলতে ভালোবাসে, কেউ প্রকৃতি নিয়ে ভাবে কিংবা কোনো শিশু খেলা নিয়ে মত্ত থাকতে চায়। শিশুর এই প্রতিভা আপনা আপনিই বের হয়ে আসে।
কিন্তু মুশকিলটা হয়, তাকে দিয়ে জোর করে কিছু করাতে গেলে। তখন সে নিজের ইচ্ছা আর অভিভাবকের চাপের মাঝখানে খেই হারিয়ে ফেলে। ধরা যাক একটি শিশু খুব চঞ্চল, দুরন্ত আর এটাই অভিভাবকের চিন্তার অন্যতম কারণ। লেখা পড়ায় মন নেই, শুধুই দুষ্টুমি।
কোনো এক স্কুল শিক্ষক খেয়াল করলেন সেই শিশুটি খুব চমৎকার অঙ্গভঙ্গি করতে পারে, অর্থাৎ দেহ ভঙ্গির মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়কে ফুটিয়ে তুলতে পারদর্শী। স্কুলের এক অনুষ্ঠানে সেই শিশুটিকে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হলো এবং সে তার সৃজনশীলতা উপস্থাপন করল। সবাই মিলে শিশুটিকে বেশ বাহবা দিল, শিশুটিও অনেক খুশি হলো।
শিক্ষক তখন তাকে বললেন- তুমি যদি ভালোভাবে লেখাপড়া কর এবং দুষ্টুমি না করে বাবা মা কথা শোন, তবে একদিন আরও বড় মঞ্চে কাজ করার সুযোগ পাবে। শুধুমাত্র এই শিশুটির সৃজনশীলতা প্রয়োগের একটি সুযোগ হয়তো তাকে পরবর্তী জীবনে একজন বিখ্যাত মূকাভিনেতার সম্মান এনে দিতে পারে। তাই, শিশুর যেকোনো সৃজনশীল কাজে তাকে বাধা না দিয়ে আগে লক্ষ্য করতে হবে সে কী করতে চায়। ভালো কিছু হলে অবশ্যই উৎসাহ দিতে হবে আর খারাপ কিছু হলে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতিতে সংশোধন করতে হবে, যাতে সে পরবর্তী কোনো কাজের আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে।
শিশুকে সৃজনশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করলে তার যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। সে নতুন নতুন ধারণা লাভ করে এবং জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পায়। তার ভেতরে চিন্তার জগৎ তৈরি হয়। সে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ লাভ করে, জড়তা থাকে না। সে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকে।
অন্যদিকে শিশুর সৃজনশীলতায় বাধা পড়লে সে নিজেকে সংকীর্ণ ভাবতে থাকে, তার চিন্তার জগৎ ছোট হয়ে আসে, সে আড়ষ্ট হতে থাকে। তার মানসিক বিকাশ পরিপূর্ণ হয় না। আর এসব কাজে শিশুর জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব সৃষ্টিকারী ক্ষেত্র হচ্ছে পরিবার-তথা বাবা-মা। শিশুর প্রশ্ন, জ্ঞান এবং ধারণাসমূহ থেকেই পরিবারের মাধ্যমে শিশুর সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটে।
শিশুর ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার প্রক্রিয়াকে সহায়তা যোগানো এবং মৌলিক চিন্তা চেতনার বিকাশে প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে ও পরিবেশ সৃষ্টি করে পিতা মাতা অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। এছাড়াও শিশুদের সৃজনশীল মনোভাব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন।
শিশুদের উপযুক্ত যেসব শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান টেলিভিশনে প্রচারিত হয় সেগুলোর মাধ্যমেও শিশুদের চিন্তার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। এসব দেখার পর শিশুরা বাবা-মাকে নানান প্রশ্ন করে অনেক কিছু জানতে পারে। এতে বেড়ে যায় তাদের জ্ঞানের পরিধি। বাবা-মা’সহ নিয়মতান্ত্রিকভাবে শিশুরা এসব অনুষ্ঠান দেখতে পারে। কারণ সৃজনশীলতার সাথে চিন্তার অভিযোজন ও সহজবশ্যতা জড়িত।
কোন শিশুর ভিতর কী ধরনের প্রতিভা সুপ্ত আছে তা আমাদের জানা নেই। তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ যদি অবারিত হয় তাহলে বিকশিত হবে তাদের মেধা ও সৃজনশীলতা। জন্মের পর থেকে শিশুর বেড়ে ওঠার এ ক্রান্তিকাল যাতে সত্য, সহজ, স্নেহ-মমতা আর ভালবাসায় পরিপূর্ণ থাকে। তার চারপাশে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পরিবেশ যেন হয় কুসুমাস্তীর্ণ। তাহলেই আমরা পাব একটি অনিন্দ্য সুন্দর এক ভবিষ্যৎ।
লেখা : জাকারিয়া রহমান