ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

টাঙ্গাইলে বেপরোয়া বালু উত্তোলনে হুমকির মুখে গ্রাম

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২২
টাঙ্গাইলে বেপরোয়া বালু উত্তোলনে হুমকির মুখে গ্রাম বেপরোয়া বালু উত্তোলনে হুমকির মুখে গ্রাম

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের বাসাইলে বেপরোয়া বালু উত্তোলন করে গড়ে তোলা হচ্ছে চায়না ‘ডেইরি ফিড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।  

এতে শতাধিক ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।

নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় ভুগছে নলখোলা নামের গ্রাম।

জানা গেছে, বাংলাদেশের ‘ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েট’ নামের একটি দেশীয় কোম্পানির যৌথ ব্যবস্থাপনায় ৫২ বিঘা জমির উপর  স্থাপন করা হচ্ছে ‘ডেইরি ফিড’ কোম্পানি।  

উপজেলার কাশিল ইউনিয়নের প্রধান সড়কের পাশেই এটি নির্মিত হচ্ছে স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. বাদল মিয়া তত্ত্বাবধানে।

গত দেড় থেকে দুই মাস ধরে ওই ৫২ বিঘা জমি ভড়াটের কাজ চলছে। সেজন্য পার্শ্ববর্তী নথখোলা এলাকার ঝিনাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে শত শত একর জমি ও শতাধিক ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।

অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয়দের রাতের আঁধারে অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে জমিগুলো বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন বাদল মিয়া, তার ভাই শহীদুল ইসলাম ও তাদের অনুসারীরা।  

যদিও অভিযোগটি নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ ভুক্তোভোগীরা ও এলাকাবাসী।  

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভুক্তোভোগী জানান, প্রথমে তার কাছে হানিফ নামের এক জমির দালাল জমি বিক্রির প্রস্তান দেন। এতে তিনি রাজি হননি। পরে বাদল মিয়া, তার ভাই শহীদুল তাকে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন ভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে জমিটি বিক্রি করতে বাধ্য করেন। তার মতো আরও অনেককেই এভাবে জমি বেচতে বাধ্য করা হয়েছেন।

পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে পরবর্তীতে স্থানীয়রা দালালদের কাছে কম মূল্যে জমি বেচতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান আরেক বাসিন্দা।  

তিনি বলেন, প্রথমে দালাল চক্র রাস্তার সামনের জমিগুলো কিনে নেয়। পরবর্তীতে অন্যান্য জমির মালিকরা বুঝতে পারেন যে, আবাদ করা ফসল আনা-নেওয়ার কোন রাস্তা নেই। তখন বাধ্য হয়ে ওসব আবাদি জমিগুলো কম মূল্যে বেচতে বাধ্য হয়েছেন তারা।  

শুধু কিনেইনি, দালালচক্রটির বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগও আনেন তিনি।  

বলেন, একজনের ২০ শতাংশ জমি কিনেছেন চক্রটি। সেটি মাটি ফেলে ভড়াট করার সময় ২০ শতাংশ ছাড়াও ওই মালিকের আরও ৫/৮ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে চক্রটি।  

সূত্র জানায় এদিকে জমি ভরাটের উদ্দেশে বালু উত্তোলনের জন্য স্থানীয় দুই থেকে আড়াইশ লোকজনকে প্রতিমাসে ১০/১৫ হাজার টাকা বেতন দিচ্ছেন বাদল মিয়া।  

বালু উত্তোলনের অনুমতি পেতে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে রয়েছে তার সখ্য। তাদের হয়েছে মোটা অংকের টাকা।

এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রমজান আলী বলেন, কোম্পানির ওই জমি ভড়াটের জন্য বাদল মিয়া নদীর পার ও নদীর মাঝখান থেকে বালু উত্তোলন করছেন। এটি অবৈধ কিন্তু তারপরও আমি কিছুই করতে পারছি না। এই ব্যবসার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতারা জড়িত। এজন্য বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না।

জানা গেছে, বালু উত্তোলনের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে সম্প্রতি সেখানে একজন সংবাদকর্মী যান। বাদল বাহিনীর লোকজন ওই সংবাদকর্মীকে ৪২ মিনিট আটকে রাখে। পরবর্তীতে সংবাদ প্রকাশ না করার শর্তে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,  নথখোলা এলাকায় ঝিনাই নদীতে বালু উত্তোলনের জন্য বসানো হয়েছে ৫/৬টি ড্রেজার মেশিন। পাশেই রয়েছে দুইটি বাল্কহেড।  

স্থানীয়রা জানান,  দিনের বেলায় নদীর পশ্চিমপারে এবং রাতে নদীর মাঝখানে ড্রেজার বসিয়ে দিনরাত উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। আর এই বালু পাইপের মাধ্যমে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে চায়না কোম্পানির জায়গা ভড়াট করা হচ্ছে। এতে করে পুরো নথখোলা এলাকা হুমকির মুখে পড়েছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে গ্রামটি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যাবে বলে শঙ্কা এলাকাবাসীর।

আব্দুল বারেক মিয়া নামের স্থানীয় বাসিন্দা জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও সরকার দলীয় লোকদের সহচার্যে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে চলেছেন টাঙ্গাইলের বালুব্যবসায়ী বিএনপি নেতা মো. বাদল। এ বেলায় আর আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বন্দ্ব থাকে না।

মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, প্রতিবাদ করলে বিভিন্ন হুমকি দেয় বালু ব্যবসায়ীরা। তারপরও এলাকাবাসী গ্রাম রক্ষায় মানববন্ধন, বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে। তাতেও কোন লাভ হয়নি। পরবর্তীতে লিখিতভাবে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, র‌্যাব এবং থানা পুলিশকেও জানানো হয়েছে। এরপর তারা যখন আসেন সে সময় বালু উত্তোলন বন্ধ থাকে। তারা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার শুরু হয় উত্তোলন।  

নারগিস বেগম নামের এক বৃদ্ধা জানান, তার স্বামী নেই। একটু জমি ছিল। সেখানেই এতোদিন ছোট একটি ছাপড়া ঘরে বসবাস করতেন। কিন্তু ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে গত এক মাস আগে তার শেষ সম্বলটুকুও নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। এখন তিনি অন্যের বাড়িতে বসবাস করছেন।

ঝিনাই নদী থেকে বালু তুলে গ্রামের উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ২ কিমি দূরের ‘ডেইরি ফিড’  এর জমিতে

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি জানান, ভিন্ন জায়গায় বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযোগ দিলেও কোন লাভ হয়নি। কর্তৃপক্ষ আসেন এবং দেখে চলে যান। কোন মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে না বিষয়টি। এসব কারণে বালুখেকোরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানির কাজে নিয়োজিত এক ব্যক্তি জানান, তারা সব দপ্তর, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেই বালু উত্তোলন করছেন।  

তিনি বলেন, বালু খেকো বাদল মিয়া ও তার ভাই সাবেক উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম দাপটে এলাকার মানুষ জিম্মি হয়ে রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরেই। বর্তমান কাশিল ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান রমজান আলীও তাদের অনুসারী। এ কারণে বালু উত্তোলনে কেউ বাধা দিতে সাহস পাচ্ছেন না। এই অবৈধ বালু ব্যবসার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও স্থানীয় এমপিও জড়িত।

এতো সব অভিযোগের বিষয়ে ‘ডেইরি ফিড’ কোম্পানির তদারকির দায়িত্বে থাকা মো. বাদল মিয়া বলেন, বালু উত্তোলনের জন্য আমি নদীর পশ্চিমপাড়ে জমি কিনেছি। সেখান থেকেই বালু উত্তোলন করে বাল্কহেড দিয়ে এপাড়ে এনে তা আনলোড করা হয়। অন্যের জমি বা নদী থেকে কোন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে না। আর যাদের জমি কিনেছি তাদের প্রত্যেককে ওই কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এ কারণেই তারা জমিগুলো বিক্রি করেছেন।

বাসাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পাপিয়া আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, মাঝেমধ্যেই অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালানো হয়। কয়েকদিন আগেও অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন চলছে কিনা সেটা জানি না।

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, চায়না কোম্পানি হচ্ছে শুনেছি। তবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে ভড়াট করা হচ্ছে কিনা এ বিষয়ে জানি না। খোঁজ নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বিষয়ে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০২২
এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।