কুমিল্লা: কুমিল্লা সদর উপজেলার গুণানন্দী গ্রাম। এ গ্রামের একটি বাড়ির নাম আরণ্যক।
শুধু বাসর লতা গাছই নয় এমন ফুল, ফলদ, ঔষধি, জলজ, শোভাবর্ধক গাছ, সব মিলিয়ে ছয়শ প্রজাতির গাছ রয়েছে তার বাগানে। কুমিল্লা মেডিকেলে কাজ শেষে প্রাইভেট প্র্যাকটিস না করে ডা. নাঈম পড়ে থাকেন বাগান নিয়ে। বাগানের প্রতি এমন ভালোবাসার কারণে এটিকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পেরেছেন তিনি।
তার বাগানে উল্লেখযোগ্য গাছের মধ্যে আছে- লাল কদম, টর্চ জিঞ্জার, স্বর্ণ কুমুদ, ডম্রুপাণি ফুল, মাধবীলতা, হংস লতা, গোল্ড কাপ ভাইন, মাংকি ব্রাশ ফ্লাওয়ার, মহেশখালীর পান, স্বর্ণ চামেলী, বারোমাসী কদম, লতা করবী, এগ ম্যাগনোলিয়া, চাইনিজ গ্রাউন্ড অর্কিড, লিথপস বা জীবন্ত পাথর, মাংসাশী বা পতঙ্গভুক গাছ, মাটি ছাড়া বাতাসে বেঁচে থাকা এয়ার প্ল্যান্ট ইত্যাদি। এসব গাছের অধিকাংশই আমাদের দেশে খুব একটা চোখে পড়ে না।
মসলার মধ্যে আছে অল স্পাইস গাছ। যাতে পাঁচ-ছয় গরম মসলার ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আছে কারিপাতা, আম আদা, একাঙ্গী মসলা, তেজপাতা, কালো আদা, সাউথ ইন্ডিয়ান আদা, ইতালিয়ান বাসিল, অরিগ্যানো। একটি অংশে সবজি চাষ করা হচ্ছে। সেখানে কয়েক প্রজাতির টমেটো যেমন ব্যানানা, ব্ল্যাক বিউটি, চেরি টমেটোর আবাদ করা হয়েছে।
এছাড়া বাগানটিতে রয়েছে ৫০ প্রজাতির গোলাপ, ২০ রকমের কাটামুকুট, ৪০ প্রজাতির মাটিতে জন্মানো গ্রাউন্ড অর্কিড, ১০ রকমের চাঁপা ফুল গাছ, ৫ প্রজাতির দোলনচাঁপা, ২০ রকম জবা, ৬০ রকম লিলি ফুলের গাছ, শতাধিক ক্যাকটাস সাকুলেন্ট শতাধিক অর্কিড ও হয়া, স্থায়ী ফুল গাছ।
ডা. নাঈম জানান, এই বাগানের গাছ সংগ্রহ করতে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে। ঢাকা, কক্সবাজার, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাগানিদের থেকে গাছ ক্রয় করতে হয়েছে নানা সময়ে। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা গাছও প্রচুর। ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীন, সিংগাপুর, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের গাছ রয়েছে এই বাগানে।
তিনি জানান, বাগান করার একমাত্র প্রতিবন্ধকতা গাছের মাত্রাতিরিক্ত দাম। জীবনযাপনের অন্যান্য সব কিছুর মতোই হু হু করে বাড়ছে যাবতীয় গাছের দাম। ভ্যাট ট্যাক্সের জন্য দেশের বাইরে থেকে আনা গাছের দাম হয়ে যায় প্রচুর। তাই সাধ থাকলেও সাধ্যের জন্য অনেক গাছ সংগ্রহ করা হয় না।
বাগানের কোন গাছ বেশি দামি-জানতে চাইলে তিনি জানান, যে গাছ যত দুর্লভ সে গাছের দাম ততটা বেশি হয়ে থাকে। দামি গাছের মধ্যে আছে অর্কিড, হয়া, গ্রাউন্ড অর্কিড, থাই শাপলা।
ডা. নাঈম জানান, ছেলেবেলা থেকেই গাছের প্রতি ভালোবাসা তার। বর্তমানে বাড়ির দুই বিল্ডিংয়ের ছাদ, বাড়ির উঠান, বারান্দা জুড়ে বাগানটির অবস্থান। বাগানের বয়স আট বছর।
কুমিল্লায় সবুজ বিপ্লবে ভূমিকা রাখতে চান আবু নাঈম:
শুধু নিজের সমৃদ্ধ বাগানই নয়, পুরো কুমিল্লা ও আশপাশের অঞ্চলকে সবুজে ভরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন আছে ডা. নাঈমের। তিনি কুমিল্লা `গার্ডেনার্স সোসাইটি' নামক একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলেছেন। বিভিন্ন ইভেন্টে ওই গ্রুপ থেকে এক লাখের বেশি বীজ ও চারা শেয়ার হয়েছে।
বাগানিদের নিজেদের মধ্যে বৃক্ষ আদান-প্রদান এবং ডা. নাঈমের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন বীজ, কাটিং, চারা প্রস্তুত করে নিজ জেলা এবং দেশের অন্যান্য জেলার বাগানিদের মধ্যে ফ্রি-তে শেয়ার করাই গ্রুপটির মূল কাজ বলে জানান তিনি।
কয়েক মাস পর পর নিয়মিত এই সংগঠন আয়োজন করে চায়ের আড্ডা, গেট টুগেদার ও ফ্রি গ্রিন শেয়ারিং ইভেন্ট। যার সবগুলো আয়োজনেই নিজ বাগানের অতিরিক্ত বীজ, কাটিং, গাছ সংগঠন পরিচালনা পর্ষদ এবং আগ্রহী সদস্যদের তরফ থেকে দেওয়া হয় বিনামূল্যে।
এছাড়াও ছাদ কৃষিতে নগর বাসিন্দাদের আগ্রহী করে তুলতে আয়োজন করেছেন ছাদকৃষি বিষয়ক কর্মশালার। নব্য বাগানিদের বৃক্ষপ্রেমী করে তুলতে বিভিন্ন সংরক্ষিত বন, উদ্ভিদ উদ্যানে করা হয় নিয়মিত আয়োজন "বৃক্ষ সন্দর্শন"।
এছাড়াও বিনামূল্যে প্রতিটি ইভেন্টেই কয়েক হাজারের বেশি বীজ, কাটিং, গাছ উপহার দেওয়া হয়ে থাকে সংগঠনটি থেকে।
ডা. নাঈম জানান, আর সবার মতো শখের বশে বাগান তিনি করেন না। শখের চেয়ে মুখ্য উদ্দেশ্য বিনামূল্যে সবুজ বিতরণ। গাছ যত দামি আর দুষ্প্রাপ্য হোক না কেন সে গাছের চারা করে শেয়ার করতে পারাই যেন তার পরম আনন্দ। বিভিন্ন রকম ফল, ফুল, ঔষধি গাছের চারা করে বিতরণ করার মাঝে সুখ খুঁজে পান তিনি।
নতুন বাগানিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যেকোনো পরামর্শ নিতে তাকে জানাতে। সব সময় নতুন বাগানিদের পাশে আছেন তিনি। মাটির সঠিক প্রিপারেশন, কি কি গাছ কেমন পরিবেশে হবে, কেমন স্থানে কেমন গাছ, গাছ কি কি যত্ন চায় এসব পরামর্শ জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে মিলবে সমাধান।
কুমিল্লায় অনেকের বাগানে হাতেখড়ি হয়েছে তার হাত ধরে। তাই অনেকেই ডাকনাম হিসেবে কুমিল্লার সবুজ ফেরিওয়ালা বা গাছতুতো দাদাভাই বা নাঈম ভাই নামে ডাকেন তাকে।
ডা. আবু নাঈম বলেন, কুমিল্লা একটি জেলা মাত্র। জেলার বাইরেও অনেক বাগানি ভাই-বোনকে বিনামূল্যে সবুজ উপহার দিয়েছি। কুমিল্লার সড়ক বিভাজকগুলোতে দেশি বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগাতে চাই। লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানে এর মাঝেই একটি শিউলি বাগান করা হয়েছে। ইচ্ছা আছে উদ্যানটিকে আরও সমৃদ্ধ করার। শালগাছের সম্প্রসারণ চাই।
কুমিল্লার শালবনটির পূর্ণ সংরক্ষণসহ এ গাছ অন্যান্য স্থানে রোপণ করার ইচ্ছা আছে। কুমিল্লা চিড়িয়াখানাসহ বিভিন্ন স্থানের জলজ ডোবায় শাপলা, পদ্মের বাগান সৃজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা আশা করি। পাশাপাশি কুমিল্লার সবগুলো খালি ছাদ ঢেকে যাবে সবুজের চাদরে। এমন সব উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যেতে সবার সহযোগিতা চাই। '
কুমিল্লার সিনিয়র বাগানি এ কে এম মোরশেদ বলেন, ডা. নাঈম বাংলাদেশে সবুজ বিস্তারে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রাইভেট চর্চা বাদ দিয়ে তিনি বাগানে সময় দিচ্ছেন। এ যুগে বাংলাদেশে এমন নির্মোহ ব্যক্তির দেখা মেলে না। সবুজ বিস্তারে তিনি সবার জন্য আদর্শ হয়ে থাকবেন।
কুমিল্লার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জানান, ডা. আবু নাঈমের কাজ সমাজের জন্য অনুকরণীয়। তাদের মতো মানুষের হাত ধরে বাংলাদেশ সবুজে ভরে উঠবে, এমন প্রত্যাশা করি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৩
আরএ