ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ইবিকাণ্ড: তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ হাইকোর্টের

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩
ইবিকাণ্ড: তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ হাইকোর্টের

ঢাকা: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কমিটিতে জেলা জজ মনোনীত একজন বিচারিক কর্মকর্তা, প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপক থাকবেন।

কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসককে এ কমিটি করে আগামী সাত দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

এক আইনজীবীর করা রিট শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। একইসঙ্গে ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের করা কমিটির প্রতিবেদনও দাখিল করতে বলা হয়েছে। আর ক্যাম্পাসের বাইরে রাখতে বলা হয়েছে নির্যাতনে জড়িত দুই শিক্ষার্থীকে। পাশাপাশি নির্যাতনের শিকারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ভুক্তভোগী চাইলে ফৌজদারি মামলাও দায়ের করারও স্বাধীনতা থাকবে। ওই ঘটনায় ধারণ করা ভিডিও যেন প্রচার না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী গাজী মো. মহসীন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি)  হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী গাজী মো. মহসীন ও আজগর হোসেন তুহিন। তখন তাদের লিখিত আবেদন দিতে বলেন আদালত। সে অনুসারে গাজী মো.মহসিন রিট করেন।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, হলের প্রভোস্ট ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে সাড়ে চার ঘণ্টা নির্যাতন চালানোর লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। অভিযোগে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী বলেন, ‘গত ৮ ফেব্রুয়ারি আমার অরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হয়। এজন্য আমি গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ৩০৬ নম্বর কক্ষে আমার এলাকার (পাবনা) পরিচিত এক আপুর রুমে গেস্ট হিসেবে উঠি। যথাযথভাবে সবাইকে সম্মান দিয়ে সেখানে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করি। এরপর ১১-১২ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় শেখ হাসিনা হলের আবাসিক ছাত্রী ও পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা আপুর নেতৃত্বে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী তাবাসসুম আপুসহ নাম না জানা আরও অন্তত ৭-৮ জন র‌্যাগিংয়ের নামে আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। তারা আমাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন। এমনকি আমার প্রাণনাশের হুমকিও দিয়েছেন তারা।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি আমাকে ডিপার্টমেন্টের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম নামে সিনিয়র আপুর রুমে দেখা করতে বলা হয়। কিন্তু আমি অসুস্থ থাকায় যথাসময়ে যেতে পারিনি। এরপর থেকেই তারা আমার ওপর চড়াও হন এবং পরে তাদের রুমে গেলে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন। হল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ারও হুমকি দেন। তারা অভিযোগ করতে থাকেন, তাদের না জানিয়ে কেন হলে উঠেছি। অথচ, হলে আমি আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে না, গেস্ট হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য উঠেছি। কিন্তু প্রথম দফায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে আমার ওপরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।

পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি আনুমানিক বিকেল ৪টায় হল প্রভোস্ট এবং সহকারী প্রক্টরের হস্তক্ষেপে বিষয়টির মিমাংসা হয়। কিন্তু রাত না পেরোতেই রোববার দিনগত রাত আনুমানিক ১১টার দিকে অন্তরা আপুসহ ৭-৮ জন আমাকে একটি গণরুমে নিয়ে যান এবং ওনারা ৭-৮ জন মিলে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। ‘আপু, আপনারা আমাকে কেন মারছেন’ বলতে গেলে উনারা আমার মুখ চেপে ধরেন এবং সজোরে চোয়ালে থাপ্পড় মারতে থাকেন। তারা বলতে থাকেন- ‘চিনিস আমাদের, আমরা কত খারাপ?’ ‘আমরা তোর কী করতে পারি কোনো আইডিয়া আছে আমাদের সম্পর্কে তোর?’। তখন আমি কান্না করে আপুকে বলি- আমাকে আর মাইরেন না, এ সময় ওনাদের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তারা লাথি মারেন। আর অকথ্য ভাষায় আমাকে ও আমার মা-বাবাকে নিয়েও গালিগালাজ করেন। ’

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘আমার বুকে আঘাত করাসহ গামছা দিয়ে আমার গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখা হয়, ধম যায় যায় অবস্থায় ছাড়া হয়, আবার ধরা হয়। আর বলতে থাকেন- ‘যা বলবো একটা কথাও যেন বাইরে না যায়’। একপর্যায়ে তারা একটা ময়লা গ্লাস আমাকে দিয়ে চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেন এবং সেটার ভিডিও ধারণ করেন। তারপর তারা বলতে থাকেন- ‘জামা খোল’, আমি জামা খুলতে না চাইলে তারা আমাকে আবার মারধর শুরু করেন এবং আমার জামা খুলে জোর করে আমাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করে রেখেছেন।

ভিডিও নিয়ে আমাকে তারা বলেন- যদি বাইরের কাউকে একথা বলিস, তাহলে তোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দেব। যাতে তুই কাউকে মুখ দেখাতে না পারিস। আর অন্তরা আপু বলেন- ‘তুই যদি প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ দিস, তাহলে তোকে মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো, যা বলেছি তা মনে থাকে যেন!’।  

টর্চার শেষে রাত আনুমানিক রাত সাড়ে ৩টার পর আমাকে অন্য একটি গণরুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর সবাই বলেন, মুখ খুললেই কিন্তু খবর খারাপ হয়ে যাবে। পরেরদিন সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) খুব সকালে জীবন বাঁচাতে আমি হল থেকে পালিয়ে গ্রামের বাড়ি পাবনায় চলে যাই। তারপর সকালে আমাকে হলে না পেয়ে অন্তরা আপুসহ ওই ৭-৮ জন সবাই আমাকে একাধিকবার ফোন দেন, কিন্তু ভয়ে আমি কারও ফোনই রিসিভ করিনি। পরে আমি বাসায় এসে আমার পরিবারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ’

এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা বলেন, সে (নবীন ছাত্রী) সিনিয়রদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছিল। ও আমাকে চেনেও না। অথচ আমার নাম ব্যবহার করে সিনিয়র ছাত্রীদের শায়েস্তা করবে বলে হুমকিও দিয়েছে। নবীন ওই ছাত্রী ওর এক ভাইকে দিয়ে তারই বিভাগের সিনিয়রকে (তাবাসসুম) হুমকি-ধমকি দিয়েছিল। পাশাপাশি ওর পরিচিত এক ভাই ফোন দিয়ে আমাকে তুলে নেওয়ার হুমকি দেয়। গত রোববার প্রক্টর স্যার, প্রভোস্ট স্যার থাকাকালীন একটা মিমাংসা হয়েছিল। বিষয়টি তখনই সমাধান হয়ে যায়। পরে আর কোনো কিছুই হয়নি। এ ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ওই ছাত্রীর সঙ্গে এরকম কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি।

পরে মঙ্গলবার এ বিষয়ে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করে হল প্রশাসন। তাদের আগামী ৭ দিনের মধ্যে ঘটনার পূর্ণ তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। বুধবার আরেকটি তদন্ত কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ৫ সদস্যের কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩
ইএস/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।