ঢাকা: ঈদুল ফিতরের সময় বাসে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয় কিনা, সেটি তদারকি করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
সোমবার (১০ এপ্রিল) পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা জানান।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় ঈদের সময় বিআরটিসির বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়—এমন অভিযোগ উঠলে ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি বলেন, ঈদের সময় বিআরটিসির বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয় কিনা, সেটি এবার তদাররি করা হবে। সরকারি সংস্থার বাস যদি ভাড়া বাড়িয়ে দেয়, তাহলে বেসরকারি সংস্থার বাস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আমরা এবার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবো।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবার ঈদের সময় যাত্রীরা অভিযোগ করেন, পরিবহনগুলো সরকার নির্ধারিত ভাড়ার থেকে বেশি ভাড়া আদায় করছে। এছাড়া কাউন্টারগুলোতে ভাড়ার তালিকা প্রদর্শন করা হয় না। একই আসন দুই-তিনজন যাত্রীর কাছে বিক্রি করা হয়। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা আজকে এখানে বসেছি।
ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি বলেন, পরিবহন খাতে যেসব বিশৃঙ্খলা আছে, সেখানে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা তদারকি সংস্থাগুলো এবার সমন্বিতভাবে কাজ করবো। পাশাপাশি এবার পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলোর সঙ্গেও আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করতে চাই। আমরা দুই পক্ষ যদি একসঙ্গে কাজ করি তাহলে অতীতের তুলনায় এবার ঈদে ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা স্বস্তির হবে।
ডিজি আরও বলেন, ঈদের সময় কাউন্টারগুলোতে কালোবাজারি হয়। সেটি বন্ধ করা প্রয়োজন। আবার কাউন্টারের স্টাফরা টিকিট আটকে রেখে পরবর্তীতে বাড়তি দামে বিক্রি করেন। এই বিষয়ও তদারকি করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, পরিবহন মালিক কর্তৃপক্ষকে যেন হয়রানি না করা হয়, সেজন্য এবার কোনো যাত্রী কোনো বিষয়ে অভিযোগ করলে প্রথমে তা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবহন প্রতিষ্ঠানকে জানানো হবে। তারা সেটি সমাধান করবেন। আর তারা যদি সেটি সমাধান করতে না পারেন তাহলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।
স্বাগত বক্তব্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার পরিবহন সেক্টরে বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি পরিবহন মালিকদের আইন মেনে যাত্রীদের সেবাদানের আহ্বান জানান। এছাড়া পরিবহন কর্মচারীদের ঈদ যেহেতু রাস্তায় কাটে, তাই তাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি খেয়াল রাখার জন্যও তিনি মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, আমি চাই, জাতীয় ভোক্তা আধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিয়মিত পরিবহনের ভাড়ার বিষয়ে তদারকি করুক। শুধু পরিবহন নয়, প্রতিটি খাতেই তাদের নিয়মিত তদারকি অভিযান পরিচালনা করা উচিত। আমি চাই, যারা বেশি ভাড়া নেয় তাদের বিরুদ্ধে সব সময় ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সব সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলুক।
তিনি আরও বলেন, সায়দাবাদ ও মহাখালী টার্মিনালে অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়ার বিষয়ে আজ বা কাল থেকে ব্যানার লাগানো হবে। আমরা সেই ব্যবস্থা করছি। গতকাল আমরা এই বিষয়ে বৈঠক করেছি। সেখানে প্রায় ১৫০টি বাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান এবং মালিক ও শ্রমিক নেতারা ছিলেন। আমরা সেখানে ঈদকে কেন্দ্র করে যাতে অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়া হয় সেই বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। পাশাপাশি এটি তদারকির জন্য আমরা একটি মনিটরিং টিম গঠন করছি। ঈদকে কেন্দ্র করে ঘরমুখো মানুষ যাতে সময়মতো বাড়ি পৌঁছাতে পারে, সেজন্য আমাদের টিমগুলো কাজ করবে।
বাস মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা ঈদকে কেন্দ্র করে কেউ অতিরিক্ত ভাড়া নেবেন না। কেউ এটি করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি তদারকি সংস্থাগুলোকেও বলবো, কেউ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে আপনারা আইনগত ব্যবস্থা নিন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান গণি বলেন, ঈদের আগে যাত্রী থাকে ২০ লাখ। এর বিপরীতে বাস থাকে মাত্র ৫ লাখ। তাহলে বাকি ১৫ লাখ মানুষ কীভাবে বাড়ি যাবে? এই বিষয়ে সবগুলো টার্মিনালের মালিক সমিতির সঙ্গে তদারকি সংস্থাগুলোর সমন্বয় করা দরকার। এছাড়া টার্মিনালের বাইরে কেউ যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নিলে বা বাস রিজার্ভ করে গেলে সেটির দায় মালিক-সমিতি নেবে না। আর ঈদের সময় যদি বাস ভাড়া ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়, তাহলে আর অবৈধভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার প্রয়োজন পড়ে না। এতে মালিক ও যাত্রী উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে।
সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ফরুক তালুকদার সোহেল বলেন, ঈদের সময় ভাড়া বেশি নেওয়া হয়, এটি আংশিক সত্য। যারা বড় বড় কোম্পানি, তারা ঈদকে কেন্দ্র করে ভাড়া বৃদ্ধি করে না। কিন্তু যারা ছোট বা সংগঠিত না, সেসব পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি করে। কারণ ঈদের সময় হয় খালি যেতে হয়, না হয় খালি ফিরতে হয়। এতে যে ক্ষতি হয়, সেটা বড় কোম্পানিগুলো পোষাতে পারলেও ছোট কোম্পানিগুলো পারে না। তাই তারা ভাড়া বৃদ্ধি করে।
বিআরটিএ-এর সহকারী পরিচালক ত্রিনয়ন রায় বলেন, প্রতিটি টার্মিনালে আমাদের নির্ধারিত মূল্য তালিকা দেওয়া আছে। ঈদের আগে পরে ৬ দিন ঢাকার তিনটি টার্মিনালে সার্বক্ষণিক আমাদের টিম থাকবে। কোনো যাত্রী অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সভায় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার থেকে বেশি মূল্যে টিকিট বিক্রি, বেশি লাভের আশায় টিকিট সংরক্ষণ করে রাখা, গাড়ির ভাড়ার মূল্য তালিকা প্রদর্শন বা সংরক্ষণ না করা, নির্দিষ্ট গন্তব্য পৌঁছার আগে গাড়ি থেকে মাঝপথে যাত্রীকে নামিয়ে দেওয়া, এসি গাড়ির ভাড়া নেওয়ার শর্তে সার্বক্ষণিক এসি সরবরাহ না করা, যাত্রীদের সাথে অসৌজন্য বা অসহযোগিতামূলক আচরণ করা, যাত্রীদের মালামাল নিয়ে টানা-হেঁচড়া করা এবং পরবর্তীতে হারিয়ে ফেলা, নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করা, যাত্রার পথে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময়ে যাত্রা বিরতি করা, নির্ধারিত আসন ব্যতীত অতিরিক্ত যাত্রী বহন (লোকাল বাস) করা, নির্ধারিত সময়ে গাড়ি না ছাড়া, গাড়িতে ওঠার সময় সিটিং সার্ভিস বলে তুলে পরে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করা, লাইসেন্স বিহীন বা অবৈধভাবে অদক্ষ ও অননুমোদিত চালক দ্বারা গাড়ি চালানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
এ সময় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আতিয়া সুলতানা, শাহনাজ সুলতানাসহ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির বাংলাদেশ ট্রাক চালক শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর প্রতিনিধি, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির প্রতিনিধি, সোহাগ পরিবহন, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, গ্রামীণ ট্রাভেলসহ বিভিন্ন পরিবহনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৩
এসসি/এমজেএফ