ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

টিকে থাকার শেষ লড়াইয়ে কমলাপুর স্টেশনের কুলিরা 

ইফফাত শরীফ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫১ ঘণ্টা, মে ১, ২০২৩
টিকে থাকার শেষ লড়াইয়ে কমলাপুর স্টেশনের কুলিরা  ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: দীর্ঘ ৯ বছর ধরে কমলাপুর রেল স্টেশনে কুলির কাজ করছেন নূর ইসলাম। বর্তমানে মুগদায় পরিবার নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।

তিনি লাল রঙের ৩৯ নম্বর কুলির পোশাক পরে কমলাপুরে দায়িত্ব পালন করছেন।

যাত্রীদের ভারি মালামাল টেনে সারাদিন পরিশ্রম করেও ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি আয় করতে পারেন না তিনি। কোনো কোনো দিন ভাগ্য ভালো থাকলে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। কিন্তু সেটা কালে ভদ্রেই হয়। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে রোজগার না বাড়ায় সংসার চালাতে এক প্রকার হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

করোনা মহামারির সময় কাজ কম থাকায় সংসার চালানোর জন্য পরিচিত জনদের থেকে বেশ কিছু টাকা ঋণ করেছিলেন। সেই ঋণ এখনও শোধ করতে পারছেন না। ঋণের বোঝায় এক প্রকার বাধ্য হয়ে কুলির পেশা পরিবর্তনের পরিকল্পনা করছেন নূর ইসলাম।

নূর ইসলামের মত কমলাপুরের বাকি কুলিদেরও একই অবস্থা। স্টেশনে কুলিদের সংখ্যা বাড়লেও আয় বাড়েনি কারও। আগে একজন কুলি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা আয় করলেও বর্তমানে তার অর্ধেকও আয় করতে পারছেন না বেশিরভাগ কুলি। যে কারণে বৈশ্বিক এই চলমান অর্থনৈতিক সংকটে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে এখন বিকল্প রোজগারের পথ খুঁজছেন তাদের অনেকেই।

মহান মে দিবসে কেমন আছেন কমলাপুর স্টেশনে লাল জামা পরা এই মেহনতি মানুষেরা? সেই খোঁজ নেওয়ার সময় এমনটাই জানিয়েছেন তারা।

ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকে খুব আশা নিয়ে নয় বছর আগে কুলির এ পেশায় যোগ দেন নূর ইসলাম। শুরুর দিকে কুলির কাজ করে ভালো রোজগার করতেন তিনি। সে সময় কমলাপুরে কুলির সংখ্যাও ছিল খুব কম ১০০-১৫০ জনের মতো। কিন্তু বর্তমানে কমলাপুরে কুলিদের সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই রোজগার কমে গেছে তাদের।

নূর ইসলামের মতো এমন ২৫০ জন নিবন্ধিত কুলি কাজ করেন কমলাপুর রেলস্টেশনে। ট্রেনে করে রাজধানীতে ফেরা মানুষের সঙ্গে আনা মালামাল টেনে জীবিকা নির্বাহ করেন এসব দিন মজুরেরা।

মূলত বছরে দুই ঈদে এবং গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে কমলাপুরের কুলিদের ভালো রোজগার হয়। ঈদের সময় প্রচুর যাত্রী যাতায়াত করে। সে সময় কুলিদের কাজের চাপ বেশি থাকায় আয় রোজগার ভালো হয়। অন্য দিকে গ্রীষ্মের সময় কমলাপুর রেল স্টেশন দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর গ্রীষ্মকালীন ফল আসে রাজধানীতে। অনেকে গ্রামের বাড়ি থেকে ফলের বস্তা আনেন। সেই সময়ে কুলিদের চাহিদা বেশি থাকে।

এবারের ঈদ মৌসুমে রোজগার কেমন হয়েছে জানতে চাইলে কুলি নূর ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর কাজ কর্ম তেমন একটা নাই। অনলাইনে সব টিকিট বিক্রি করায় স্টেশনে টিকিট ছাড়া কোনো যাত্রী ছিল না। যাত্রী কম থাকলে আমাদের ইনকামও কম হয়। আগে ঈদের সময় দিনে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতাম। কিন্তু এ বছর দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করতেই কষ্ট হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ভোরে স্টেশনে আসছি, এখন দুপুর হয়ে গেছে, মাত্র ২০০ টাকার কাজ করছি। অন্যান্য বছর ভালো ইনকাম থাকতো। আমার নিজেরই দুপুরে ভাত খেতে ১৫০ টাকা খরচ হয়ে যায়। আগে বাসা ভাড়া দিতাম তিন হাজার টাকা আর বর্তমানে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দেই। ঢাকা শহরের এমন অবস্থা হইছে যে, পানিটা পর্যন্ত কিনে খেতে হয়। সারাদিন পরিশ্রম কইরা দিন শেষে বাসায় যদি কোনো টাকা নিতে না পারি তাহলে এই পেশায় থেকে লাভ কি!

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে কমলাপুর রেলস্টেশনে কুলি চার্জের তালিকা টাঙিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের সুবিধার্থে স্টেশনে লাগেজ বহনকারী কুলিদের আইডি কার্ড, পোশাকের মাধ্যমে কুলি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নসহ মালামাল বহনে ট্রলি, প্রতিবন্ধী-অসুস্থ, বয়স্ক রোগীদের জন্য হুইলচেয়ার সরবরাহ করা হয়েছে।

প্লাটফর্মের বিভিন্ন স্থানে কুলিদের মূল্য তালিকায় দেওয়া আছে। সেখানের চার্টের মতে ২৮ কেজির একটি ব্যাগ ১৫ টাকা, দুটি ব্যাগ ২০ টাকা, ৩৭ কেজির দুটি ব্যাগ ২৫ টাকা, ৫৬ কেজি পর্যন্ত ব্যাগ ৩৫ টাকা। এছাড়া ট্রলি যাত্রীরা ব্যবহারে ১৫ টাকা, কুলি ব্যবহারে ২০ টাকা, হুইল চেয়ার কুলি ব্যবহারে ২০ টাকা। এমন চার্জে যেতে রাজি না হলে কুলিদের আইডি নম্বরসহ স্টেশন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে। এমন পদক্ষেপে সাধারণ যাত্রীরা খুশি হলেও সন্তুষ্ট নন স্টেশনের কুলিরা।

স্বাধীনতার পর থেকে এই স্টেশনে কুলির কাজে করছেন আব্দুর রশীদ মিয়া। রেলওয়ে যে চার্জ নির্ধারণ করে দিয়েছে তা নিয়ে খুশি নন এই জ্যেষ্ঠ কুলি। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, পরিশ্রম করব আমরা আর দাম ঠিক করবেন আরাম আয়েশে এসির নিচে বসে থাকা রেলের কর্মকর্তারা। এতো বছর ধরে কমলাপুরে কত কুলি কাজ করেছেন, রেলের কেউ কি কখনো আমাদের খবর নিয়েছেন? স্টেশনে আমাদের বসার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। আদেশ দেওয়া সহজ কাজ, কিন্তু এর ফলে অন্যের কি অবস্থা হবে সে দিকেও নজর রাখতে হবে। এখন আর কেউ এই পেশায় আসতে চায় না। যারা আছেন তারাও অন্য পেশা খুঁজছেন। সরকার আর রেল কর্তৃপক্ষ আমাদের না দেখলে সামনে চলা কষ্ট হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, এখানের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে আমাদের সংসার চলে। রেলওয়ে যে চার্জ নির্ধারণ করে দিয়েছে, এটা একেবারেই কম। তবে কোনো যাত্রীই এতো কম টাকা দেন না। কম হলেও ৫০ টাকা দেন।

এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমলাপুর স্টেশনে যত ধরনের পার্সেল আসে সেগুলো বহন করার জন্য মাত্র সাত জন কুলি কাজ করে। যদিও এই পার্সেল বহন করা কুলিদের আয় যাত্রীদের মালামাল বহন করা কুলিদের থেকে অনেক ভালো। যাত্রীদের মালামাল বহন করা কুলিরা যেখানে গড়ে দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় করেন, সেখানে পার্সেল বহন করা কুলিদের আয় দৈনিক এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। তবে এই আয়ের থেকেও একটা অংশ দিতে হয় কুলিদের যিনি সরদার তাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কুলি বাংলানিউজকে জানান, কোনো পার্সেল বহন করা কুলি যদি দিনে ৮০০ টাকা আয় করেন, তাহলে সেখান থেকে সরদারকে ১০০ টাকা দিতে হয়। এছাড়া নতুন যারা এ পেশায় আসতে চান, তাদের ক্ষেত্রে সরদারকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কাজের অনুমতি নিতে হয়।

এ বিষয়ে কথা বলতে কুলিদের সরদার মো. মোবারক মিয়ার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও সে দিন তিনি কমলাপুরে ছিলেন না। অন্য কুলিদের কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে ফোন করলে সংযোগটি বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি গত বছরের অক্টোবরে সরদারির দায়িত্ব পান। এ দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষ তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

মূলত এই সরদারি ঠিক করা এবং যাত্রীবাহী কুলিদের মূল্য তালিকা নির্ধারণ করা বাদে রেল কর্তৃপক্ষ কুলিদের আর কোনো বিষয় দেখেন না। এমনটাই জানিয়েছেন সেখানকার কুলিরা। তাই কুলিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কর্তৃপক্ষ যেন এ সব কুলিদের পুনর্বাসন এর ব্যবস্থা করে, এমনটাই চান কমলাপুরের লাল জামা পরা দিনমজুর কুলিরা।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৩
ইএসএস/এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।