ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দোভাষীর বেতনই বছরে ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা! 

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৫ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২৩
দোভাষীর বেতনই বছরে ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা! 

ঢাকা: লাইটহাউজ প্রকল্প নামে পরিচিত নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ‘স্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ প্রকল্পের একজন দোভাষীকেই মাত্র এক বছরে পরিশোধ করা হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ টাকা।  

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার সামি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের দোভাষী মো. জসিম শেখকে ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৩ জুন প্রকল্পের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত হতে এই টাকা দেওয়া হয়।

 

অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষজ্ঞসহ নৌপরিবহন সংশ্লিষ্টরা এই ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন।

উপকূল এলাকা থেকে গভীর সাগরের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনার লক্ষ্যে সাতটি লাইটহাউজ ও সাতটি কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় নৌ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় একটি ১১তলা ভবন নির্মাণও রয়েছে। প্রকল্পটির সর্বশেষ বর্ধিত ব্যয় ৭৭৯ কোটি টাকা।  

তবে বাস্তবায়নে ধীরগতিসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় তা খতিয়ে দেখতে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (সদ্যবিদায়ী) কমডোর নিজামুল হক গত ১০ এপ্রিল চার সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি গঠন করেন।  

অধিদপ্তরের সদ্যসাবেক পরিচালক ও সরকারের উপসচিব বদরুল হাসান লিটনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি গত ২১ এপ্রিল মহাপরিচালকের দপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনের একটি ছায়ালিপি বাংলানিউজের হাতে এসেছে।  

সূত্র মতে, অধিদপ্তরের নিরীক্ষা কমিটি নৌ মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার মাধ্যমে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে দোভাষীর বিল ছাড়াও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবু সাঈদ মো. দেলোয়ার রহমান নিজেই গত বছরের ৩ এপ্রিল প্রশাসনিক ব্যয়-খাত হতে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৪০ টাকা নিয়েছেন। তবে এসব ব্যয় প্রকল্পের ক্যাশ রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করার তথ্য চাওয়া হলেও পিডির দপ্তর থেকে কমিটিকে তা দেওয়া হয়নি। এর ফলে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত নীতিমালা (পিপিআর)-২০০৮ এর ৫ ধারা লঙ্ঘন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।  

নিরীক্ষাকালে এ প্রকল্পের অর্থব্যয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক অসংগতি ধরা পড়ে। অস্তিত্বহীন ব্যক্তির নামে ভৌতিক বেতন-ভাতা প্রদানের তথ্যও উঠে এসেছে। তবে এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দপ্তর এবং নৌ মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা মেলেনি। এমনকি মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের মৌখিক নির্দেশনা সত্ত্বেও তার দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করেননি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।  

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরের সকল বিল পাওয়া না গেলেও অপর্যাপ্ত বিলগুলো পর্যালোচনা করে অনেক অসংগতি মিলেছে। বিলগুলো পিপিআর-২০০৮, সরকারি আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রসহ সরকারি বিধিবিধান সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।  

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত হতে মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও জুমাইমাহ ইন্টারন্যাশনাল (জেভি) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ১৩ লাখ ১৯ হাজার ২৭৭ টাকা। গত বছরের ১৫ জুন মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট এই টাকা গ্রহণ করে। তবে নৌ মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে এই বিলটি চাওয়া হলেও কমিটিকে দেওয়া হয়নি। এমনকি কাজ সম্পন্ন হওয়ার মেজারমেন্ট বুক চেয়েও পায়নি কমিটি।  

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আরকেএস ট্রেডার্সকে ফি, চার্জ ও কমিশন খাত হতে আলাদাভাবে ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৬০০ টাকা ও ১ লাখ ৯৩ হাজার ৫২০ টাকা এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি খাত হতে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭২০ টাকা প্রদান করা হয়েছে। তবে তিনটি বিলের মধ্যে একটি পাওয়া গেলেও অপর দুটি দেয়া হয়নি কমিটিকে।  

মেরামত ও সংরক্ষণ খাতের আসবাবপত্র এবং ফিটিংস ও ফিক্সার উপখাত হতে একইদিনে (১৫ জুন, ২০২২) আলাদা দুটি টোকেনে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩২৮ টাকা দেওয়া হয়েছে। এই দরপত্র কোটেশন কমিটিতে পাট অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালককে রাখা হলেও নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি নেওয়া হয়নি। কিন্তু এ সংক্রান্ত চিঠিতে নৌ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ পিডিসহ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ভিন্ন ঠিকানায় আলাদা কার্যালয় রয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।  

নিরীক্ষা কমিটি নৌ মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দপ্তর থেকে এ প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এ পর্যন্ত ১৭ কোটি ১৮ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে। এরমধ্যে অনাবাসিক ভবনখাতে ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি ৫১ লাখ ৬৯ হাজার ১০০ টাকা। এ টাকার মধ্যে সামি কনস্ট্রাকশন দুটি বিলে যথাক্রমে ৩ কোটি ১১ লাখ ৪২ হাজার ৮০২ এবং ২ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু কাজ সম্পন্নের ফিল্ড বুকের (সাইট বুক) কপি কমিটিকে দেওয়া হয়নি। অবশিষ্ট টাকা দেওয়া হয়েছে সিডিডিএল এবং স্পিডি গ্রুপ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে।  

সূত্র মতে, পেশাগত সেবা, সম্মানী ও বিশেষ হার খাতের কনসালট্যান্সি উপখাত হতে ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইন, বেটস কনসালট্যান্ট এবং পাল্স কনসালট্যান্ট- তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ৬৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪০০ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে।  

ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইনের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে নকশায় নৌ অধিদপ্তরের অনুমোদনের শর্ত থাকলেও অনুমোদন নেওয়ার কোনো প্রমাণ পায়নি কমিটি। এছাড়া বেট্স কনসাল্ট্যান্টকে নিয়োগের ক্ষেত্রে পিপিআর-২০০৮ এর ১১০ ধারার ১-৬ উপধারা মানা হয়নি।  


প্রতিবেদনে বলা হয়, পাল্স কনসালট্যান্টের বিলে সাইট বুকের তথ্য পায়নি কমিটি। এছাড়া পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী, একক উৎস্যভিত্তিক পরামর্শক নিয়োগে ফার্ম বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ লাখ বিল প্রদান করা যায়। কিন্তু উল্লেখিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের দুটিকে ২০ লাখ টাকার বেশি করে বিল পরিশোধ করা হয়েছে।  

এছাড়া চলতি বছরের ১৯ মার্চ অনাবাসিক ভবনখাত হতে স্পিডি গ্রুপকে পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯১ টাকা। এসব টেন্ডার ইজিপিতে করার কথা থাকলেও বিলে তা করা হয়নি। আজকের প্রভাত ও দ্য ডেইলি আর্থ নামের দুটি অখ্যাত বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় এ সংক্রান্ত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।  

সূত্র মতে, প্রকল্পের টাকা থেকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত আনোয়ার শিকদার ও মো. আনছার আলী নামে দুজন গাড়িচালকের নামে বেতন বিল উত্তোলন হচ্ছে। তবে বাস্তবে মো. আনছার আলী নামে কোনো চালকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞসহ নৌ পরিবহন সংশ্লিষ্টরা এসব ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন।  

জানতে চাইলে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল বলেন, একটি ছোট প্রকল্পে বাংলাদেশি একজন দোভাষীর মাসিক বেতন ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫০ টাকা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুধু কালক্ষেপনই হচ্ছে না, প্রতিটি পর্যায়ে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে।  

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে পিডি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সহ-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান প্রকৌশলী ইনামুল হক।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২৩
টিএ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।