ফরিদপুর: পদ্মা নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফরিদপুর জেলা সদরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত ২৬ জুন থেকে এ ভাঙন শুরু হয় ইউনিয়নের ইউসুফ মাতুব্বরের ডাঙ্গী গ্রামে।
পাশাপাশি ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও দেড় শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি পাকা মসজিদ।
এলাকাবাসী জানায়, গত ১২ দিন ধরে নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনে মানুষ বসতভিটা, ফসলি জমি হারাচ্ছেন। অথচ সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে তাদের সাহায্য করাতো দূরের কথা চোখের দেখা দেখতেও কোনো কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে আসেননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উল্লিখিত ব্যক্তিরা ছাড়াও ওই এলাকার মাইমুদ্দিন মোল্লা, আলী তালুকদার, মোকা তালুকদার, শাহা শেখ, লাল মোল্লা, কবির খলিফা, আলতাফ মিয়া, জহিরুল শেখ, শহীদ শেখ, আলেপ শেখ রাকিব মোল্যাসহ শতাধিক পরিবারের বসতভিটা গত ১২ দিনে বিলীন হয়ে গেছে।
এদিকে এ ভাঙন রোধে গত ৫ জুলাই থেকে বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ফরিদপুর।
শনিবার (৮ জুলাই) সকালে ভাঙন কবলিত ওই এলাকায় ঘুরে এ তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ইউসুফ মাতুব্বরের ডাঙ্গী গ্রামের উত্তরে কালাম শেখের বাড়ি থেকে শুরু করে দক্ষিণে কাইমুদ্দিন মোল্লার বাড়ি পর্যন্ত নদীর পাড়ে দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ ভাঙন চলছে। ইতোমধ্যে নদীর পাড় ভাঙতে ভাঙতে ৩০০-৪০০ মিটার ভেতরে ঢুকে গেছে। ফলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ফসলি জমি। আবার ভাঙনের মুখে শস্য কেটে নিতে দেখা যায় এলাকার লোকজনদের।
এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৬ জুন থেকে ভাঙন শুরু হয়েছে। তবে প্রথম ৩-৪ দিন ভাঙনের তীব্রতা ছিল বেশি। বর্তমানে ভাঙনের গতি কমে এলেও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
ওই এলাকার বাসিন্দারা জানান, ভাঙনের কারণে তারা এবার ঈদের আনন্দ করতে পারেননি। ঈদের দিন তাদের বাড়িঘর সরিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।
ভাঙন কবলিত এলাকায় জ্যোৎস্না বেগম (৩৫) নামে এক নারীকে দেখা গেল ক্ষেত থেকে তিল কেটে নিতে। তিনি তার দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তিল কাটছেন।
জ্যোৎস্না বলেন, ‘পদ্মা নদী আমার ভিটা-মাটি সব কাইড়া নেছে। জমিও ভাইঙা যাইতাছে। তাই যতটুকু পারি দুই ছেলেরে নিয়া জমির তিল কাইটা নিচ্ছি।
ওই এলাকার বাসিন্দা কৃষক লালন শেখ (৪৫) বলেন, আমার ২ একর ফসলি জমি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হয়ে গেছে বসতভিটা।
একই এলাকার বাসিন্দা আনসারউদ্দিন মোল্লা (৬৫) বলেন, নদীর ভাঙনে আমার ১ একর জমি বিলীন হয়ে গেছে। এবার আমাদের ঈদ ছিল না। ছেলে-মেয়ের মুখে একটু সেমাই তুইলা দিতে পারি নাই। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই।
এছাড়া ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে সূর্য শেখ (৫০) ও আমজাদ শেখসহ (৪৫) আরও দেড় শতাধিক পরিবার। ভাঙন কবলিত জায়গা থেকে ১২০ মিটার দূরে রয়েছে চর টেপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউসুফ আলী মাতুব্বরের ডাঙ্গী জামে মসজিদ। এ প্রতিষ্ঠানগুলোও ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
চর টেপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকান্ত ঘোষ বলেন, ঈদের আগে ভাঙনের পরিস্থিতি জানিয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) লিখিত চিঠি দেওয়া হয়েছে। আগামী ১০ জুলাই উপজেলা মাসিক সমন্বয় সভায় এ বিষয়টি তোলা হবে। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তীসময়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
নর্থ চ্যানেল ইউপি চেয়ারম্যান মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ভাঙন কবলিত কোনো ব্যক্তিকে কোনো সাহায্য দেওয়া হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে। ভাঙন রোধে কাজ চলছে সীমিত জায়গায়। কিন্তু ভাঙনের ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি অনেক বেশি। পরিস্থিতি এমন যে -একদিকে কাজ করা হলে, অন্যদিক ভেঙে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর সদরের ইউএনও লিটন ঢালী বাংলানিউজকে বলেন, ভাঙনের ব্যাপারে আমরা সাম্প্রতিক ফরিদপুর ডিসি সাহেবের মাধ্যমে পাউবো ফরিদপুরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে ভাঙন রোধে কাজ শুরু করেছে।
ইউএনও বলেন, আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি বছরই ওই এলাকার পদ্মার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াই। এবারও ভাঙন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা চেয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যানদের জানানো হয়েছে। তাদের দেওয়া তালিকা পাওয়ার পরে আমরা এবারও ত্রাণসামগ্রী ও অন্যান্য সহায়তার কাজ শুরু করব।
পাউবো ফরিদপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম সাহা বলেন, ভাঙন রোধে বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা শুরু হয়েছে। দুইটি প্যাকেজে ভাঙন কবলিত এলাকার ১৫৩ মিটার অংশে এ কাজ চলছে। আর দুইটি প্যাকেজে ২৫০ কেজি বালুসহ ১১ হাজার ৩৪টি জিও ব্যাগ এবং ১৭৫ কেজি বালুসহ ২ হাজার ৩৭৭টি জিও ব্যাগ ফেলার কাজ চলছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০২৩
এসআরএস