ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ মে ২০২৪, ০১ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

দুই সন্তানকে বাসায় তালাবদ্ধ করে রিকশা চালাতে যান বাবা

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০২৩
দুই সন্তানকে বাসায় তালাবদ্ধ করে রিকশা চালাতে যান বাবা বাবার রিকশা নিয়ে বের হলে এভাবেই তালাবন্দি ঘরে থাকতে হয় ৩ বছরের মরিয়ম ও ১৮ মাস বয়সী নূরকে

বরিশাল: দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে বরিশাল নগরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন রনি সিকদার ফিরোজ নামের এক যুবক।  

বাবার বদৌলতে খেয়ে বেঁচে থাকলেও, মা হারা সংসারে মানবেতর জীবন-যাপন করছে সাড়ে ৩ বছরের মরিয়ম ও ১৮ মাস বয়সী নূর।

কারণ দেখভাল করার কেউ না থাকায় নিজের দুই শিশুসন্তানকে বাসায় তালাবদ্ধ করে রেখে রিকশা নিয়ে বের হতে হয় রনি সিকদারকে।   

জানা গেছে, দুই সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে নিরুপায় হয়েই এমনটি করতে হচ্ছে এ রিকশাচালককে। ২০২১ সালে রনির স্ত্রী মরিয়ম আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকে মা হারানো শিশু মরিয়ম ও নূরের মায়ের ভূমিকাও পালন করতে হচ্ছে রনিকেই।  

বরিশাল নগরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম কাউনিয়া এলাকার হাজেরা খাতুন স্কুল সড়কের মোহাম্মদিয়া মসজিদ সংলগ্ন বাসার একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে বাস করছেন রিকশাচালক রনি সিকদার ফিরোজ।  

রনি ছাড়া শিশু দুটিকে দেখার আর কেউ নেই। তার প্রতিদিন রিকশা নিয়ে বের হওয়ার আগে নিজের দুই সন্তানকে ভেতরে রেখে ঘরের সামনের দরজায় তালা মারেন তিনি। সারাদিন রিকশা চালিয়ে নির্ধারিত পরিমাণ আয় হলেই বাসায় ফেরেন। মুক্ত করেন দুই সন্তানকে। আর তালাবদ্ধ থেকে দিনশেষে বাবাকে পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে যায় শিশু দুটি। চোখে-মুখে ভাসে হাসির ঝিলিক। তারা ভুলে যায় তাদের বন্দি জীবনের দুর্দশার কথা। সব আনন্দ তারা খুঁজে পায় বাবার মাঝেই।

এভাবেই দিনের পর দিন পিতৃত্বের অন্যরকম এক পরীক্ষা দিয়ে চলছেন রনি।

এ বিষয়ে রনি জানান, আমি নিরুপায়। ওদের কার কাছে রেখে যাব? কে দেবে নিরাপত্তা! তাই এভাবে তালাবদ্ধ করে মহান সৃষ্টিকর্তার ওপরে ভরসা করেই তাদের রেখে যাই।

কীভাবে দুই সন্তান লালনপালন করেন, এমন প্রশ্নে রনি সিকদার বলেন, প্রতিদিন ভোরে উঠে ওদের গোসল করাই। নাশতা করিয়ে তালা মেরে রিকশা নিয়ে বের হই। দুপুর ১টার দিকে ঘরে ফিরে দুপুরের রান্না করি। খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে সন্তানদের রিকশার সিটে বসিয়ে বের হই। তখন হয়তো দু-চারজন যাত্রী পেলেও পেতে পারি। বিশেষ করে সিটে বাচ্চা বসা দেখলে উঠতে চায় না। এভাবে দিন চলছে।

রাতের বরিশাল নগরে দুই সন্তানসহ রিকশাচালক রনি
স্থানীয়রা বলছেন, পানি পানসহ জরুরি কোনো সমস্যা হলে শিশু দুটির মধ্যে যে বড় সে জানালা দিয়ে হাত নেড়ে ভাঙা ভাঙা ভাষায় বাইরের লোকজনের কাছে আবদার জানায়। তখন সহৃদয়বান কেউ দেখতে পেলে তাদের কাছে আসেন। আর না পেলে নাই।  

জানা গেছে, ঝালকাঠির কিস্তাকাঠি গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে রনি সিকদার ফিরোজ জীবিকার সন্ধানে প্রায় ১৫ বছর আগে বরিশাল শহরে আসেন। ২০১৯ সালে আগৈলঝাড়ার বাসিন্দা মারজানকে বিয়ে করেন রনি। এরপর রিকশা চালানোর উপার্জনেই দুজনের সংসার এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের সংসারে আসে এই দুই সন্তান। এর পরই কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো বিপদ এসে রনির জীবন লণ্ডভণ্ড করে দেয়।  

সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রনি বলেন, ২০২১ সালে আমাদের বড় মেয়ে মরিয়মের বয়স ছিল ১৮ মাস আর ছোট ছেলে নূরের বয়স ছিল ৫ মাস। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমার স্ত্রী মারজান বাবার বাড়িতে বেড়াতে যান, আমি নিজে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। এরপর মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা হতো, কিন্তু ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ ভোররাতে আমার শাশুড়ি কল দিয়ে আমাকে আগৈলঝড়া যেতে বলেন। গিয়ে দেখি আমার স্ত্রী মৃত, সে নাকি আত্মহত্যা করেছে।

তিনি বলেন, কিছু বোঝার আগেই আমাকে রশি দিয়ে বেঁধে মারধর করে পুলিশে দিয়ে দেয় শ্বশুরবাড়ির লোকজন। আর আমার নামে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা দেওয়া হয়। তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। যে মামলায় ৪ মাস ১৮ দিন কারাভোগের পর রেহাই পাই।  

রনি আরও বলেন, কারাগার থেকে বের হয়ে দুই সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে আসি এবং পশ্চিম কাউনিয়ার সেই পুরোনো ভাড়া বাসায় উঠি। এরপর আর শ্বশুরবাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি।

জীবিকার জন্য রিকশা চালাতে বাইরে গেলে শিশুদের তালাবদ্ধ ঘরে রেখে যেতে খুব খারাপ লাগে জানিয়ে রনি বলেন, এখন প্রতিটি সেকেন্ড ও মিনিট হিসেব করে চলি। সব ধরনের ঝামেলা-বিপদ এড়িয়ে চলি। কারণ আমি না থাকলে আমার সন্তানদের দেখার কেউ নাই। এমন একটা সমস্যায় থাকি, যে সন্তানদের গাড়িতে উঠিয়ে নিলে যাত্রীরা উঠতে চায় না। আবার গাড়িতে ওঠালেও চিন্তার শেষ থাকে না। কারণ ওরা তো কিছুই বোঝে না, পড়ে গেলে কী হবে। তাই বাধ্য হয়ে বাসায় রেখে আসি।

দুপুরের কোনো এক সময় ঘরের তালা খুললে সন্তান দুটি এভাবেই বাবা রনির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে

স্ত্রীর আত্মহত্যার কারণ আজও অজানা রনির। কারণ, ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন মারজানাকে। স্ত্রীও তাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ফুটফুটে দুটি সন্তানও তাদের। তবে কোন কারণে স্ত্রী আত্মহত্যা করতে যাবেন?

রনি বলেন, আমিতো আমার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতাম। দুজনের মধ্যে খুব বোঝাপড়া ছিল। কিন্তু হঠাৎ তার কী হলো যে মারজানকে আত্মহত্যা করতে হলো!

তিনি জানান, রিকশাওয়ালাকে বিয়ে করার বিষয়টি শাশুড়ি মেনে নিতে পারেননি। রিকশাওয়ালাকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন করে বিয়ে করতে মেয়েকে চাপ প্রয়োগ করতেন তিনি।  

এ রিকশাচালক বলেন, কত সন্তানদের বাবা-মা ফেলে রেখে চলে যান, কিন্তু আমি তো নিরুপায়। স্ত্রী নেই তাতে তো আর সন্তানদের ফেলে রেখে যেতে পারি না। ওদের আমি ছাড়া কেউ নেই। বিনা দোষে জেল খেটেছি, জীবনের কষ্টগুলো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি। আবার নতুন করে বিয়ে করলে সেও যে ওদের দেখবে এর নিশ্চয়তা কী?  আমি ছোটবেলায় মা হারিয়েছি, তারপর ভালোবাসার মানুষ স্ত্রী মারজানকেও হারিয়েছে অল্পদিনে। এখন আর সন্তানদের হারাতে চাই না।  

বর্তমানে এক রুমের যে বাসায় দুই সন্তানকে নিয়ে রনি ভাড়া থাকেন, তার মাসিক ভাড়া ১ হাজার ৭০০ টাকা। আর যে রিকশা তিনি চালান তার দৈনিক ভাড়া ৩০০ টাকা। আয় থেকে বাকি যে টাকাটা থাকে তাতেই চলছে দুই সন্তান আর নিজের জীবন। তবে আয়ের সীমাবদ্ধতায় তিনজনের সংসারে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নেই। সন্তানদের জন্য ভালো পোশাকেরও ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছেন রনি।

রনির দুই সন্তান মরিয়ম ও নূর।

রনি জানান, কেউ একটি দোকানের ব্যবস্থা করে দিলে সন্তানদের এভাবে তালাবদ্ধ করে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে রিকশা নিয়ে বের হতেন না তিনি। চোখের সামনে রেখেই দেখাশোনা করার পাশাপাশি জীবনটা চালিয়ে নেওয়া কিছুটা সহজ হতো তার।

দুই সন্তানকে দেখভালের জন্য কি প্রতিবেশীও নেই? সে প্রশ্নে খোঁজ নিতে গিয়ে কথা হয় রনির প্রতিবেশী রুনু বেগমের সঙ্গে।  

তিনি বলেন, অবুঝ দুই শিশুকে এভাবে ঘরের ভেতরে রেখে দরজায় তালা মেরে রেখে যান তার বাবা, যা দেখতে খুবই খারাপ লাগে। তারপরও রনি যখন বাসা থেকে বের হয় তখন অনেকের কাছে ঘরের চাবি দিয়ে যেতে চান। কিন্তু ভয়ে কেউ রাখতে চায় না। যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে দায় তো চাবি যার কাছে তারই হবে। তবে মরিয়ম ও নূর কোনো শব্দ করলে কিছু চাইলে তা দেওয়ার চেষ্টা করি এবং ওই জানালা দিয়েই কথাবার্তা বলি।

আরেক প্রতিবেশী ব্যবসায়ী সুলতান হাওলাদার বলেন, রনি ও তার দুই সন্তানের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হয়, অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। তারপরও কিছু করার নেই, বাস্তবতা এমনই। আমার সামর্থ্য থাকলে ওর জন্য একটি দোকান করে দিতাম। যার মধ্যে সন্তানদের নিয়েই তিনি থাকতে পারতেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৪ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০২৩
এমএস/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।