ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ঝালকাঠি দুর্ঘটনা: চালক হালকা লাইসেন্সে চালাতেন ভারী যান 

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০২৩
ঝালকাঠি দুর্ঘটনা: চালক হালকা লাইসেন্সে চালাতেন ভারী যান 

ঝালকাঠি: বরিশাল-খুলনা মহাসড়কের ঝালকাঠি সদর উপজেলার ছত্রকান্দা বাস দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রশাসনের পর ঝালকাঠি বাস মালিক সমিতিও তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।  

মালিক ও শ্রমিকসহ মোট ছয়জনের এই কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত করে মালিক সমিতির কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

জানা গেছে, চালক মোহন হাওলাদার এক সময় দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটির সুপারভাইজার ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি চালক হয়ে গাড়ি চালানো শুরু করেন। খোদ ঝালকাঠি বাস মিনিবাস মালিক সমিতি এই চালকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।  

এদিকে পুলিশ বাদী হয়ে চালকসহ তিনজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে। চালক মোহন হালকা শ্রেণীর গাড়ির লাইসেন্স দিয়ে চালাতেন ভারী যানবাহন ও যাত্রীবাহী বাস।

ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালগামী বাশার স্মৃতি বাসটির মালিক গুরুতর অসুস্থ বলে মালিক সমিতির দাবি। তাই চালকের বিষয়ে মালিক পক্ষের কারো কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঝালকাঠি বাস ও মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, মোহন আমার সংগঠনের সদস্য না হলেও মালিক তাকে দিয়ে গাড়ি চালাতেন। ওকে দিয়ে গাড়ি না চালানোর জন্য আমি মালিক কালাম ভাইকে নিষেধ করেছি। আমি একবার না একাধিক বার তাকে নিষেধ করেছি। না শোনায় আমি লিখিতভাবে মালিক সমিতির কাছে এ বিষয়টি অবহিত করি। বিগত ছয় মাস আগে লিখিতভাবে সমিতিকে জানানো হয়েছে। মোহন কোনো ড্রাইভারই না। তিনি এর আগে কোনো গাড়ি চালাতেন না। মালিকের কপালে ভোগান্তি ছিল বলেই ওকে দিয়ে গাড়ি চালাতেন। তিনি যদি আমাদের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য হতেন তাহলে ছবি, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি, জাতীয় পরিচয়পত্র, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট জমা দিতে হতো। তা না দেওয়ায় ওকে সদস্য করা হয়নি। এই গাড়ি চালানোর আগে চালক মোহন হাওলাদার একই গাড়ির সুপারভাইজার ছিলেন। মালিক সেই মায়ায় পড়ে হয়ত এক বছর আগে তাকে ড্রাইভার পদে চাকরি দিয়েছেন। তার লাইসেন্স আছে বলে আমার জানা নেই। এ কারণেই আমি মালিককে বলেছি আপনি আপনার ড্রাইভারের জন্য আমাকে সদস্য কার্ড দেওয়ার অনুরোধ না করলেই ভাল হয়। এই দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ে গেছে। যে কান্না চেষ্টা করেও থামাতে পারিনি। এর চেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আর কিছু নেই। চালক মোহন এখন গা ঢাকা দিয়েছে।

দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির তথ্য নিতে ঝালকাঠি বিআরটিএ অফিসে গিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালের মডেলের এই বাসটির ফিটনেসের মেয়াদ আছে ২০২৪ সনের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। ট্যাক্স টোকেনের মেয়াদ একই বছরের ৯ মে এবং রুট পারমিটের মেয়াদ ২০২৫ সনের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ৫২ সিটের এই বাসটি খুলনা-বরগুনা রুটে চলাচলের অনুমতি থাকলেও দুর্ঘটনা ঘটে ভান্ডারিয়া-বরিশাল রুটে।

ঝালকাঠি মালিক সমিতি সূত্র জানায়, সমিতির সিদ্ধান্তে বরিশাল বিভাগের ৩২টি রুটেই মালিকপক্ষের সব গাড়ি চলাচল করতে পারবে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে বাসটির বৈধ কাগজপত্র থাকলেও চালকের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় সে কি পলাতক। এমনকি দুর্ঘটনার পর সেখানে গিয়ে ঝালকাঠি সদর থানার এসআই শফিকুল ইসলাম গাড়ির কাগজপত্র ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স উদ্ধারের কথা জানালেও তা দেখাতে পারেনি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন তা থানায় জমা দেওয়া হয়েছে।

ঝালকাঠি বাস মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের সমন্বয়ে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছি। আগামী পাঁচ কার্য দিবসের মধ্যে কমিটি প্রতিবেদন দেবে। এটা আমাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব কমিটি। প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র নেই।  
কেন এই তদন্ত কমিটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিগত দিনে ঝালকাঠি বাস মালিক সমিতির কোনো গাড়ি এতো বড় দুর্ঘটনায় পড়েনি। অবশ্যই এর কোনো যুক্তিসংগত কারণ আছে। যা আমাদের চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে সতর্ক হতে হবে। এখানে চালক মোহন এর ড্রাইভিং লাইসেন্স হালকা না ভারী তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ হালকা লাইসেন্স থাকলে এসব রুটে ভারী গাড়ি চালানোর কোনো সুযোগ নেই। যেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তবে অবশ্যই এই দুর্ঘটনার দায় কারো না কারো নিতে হবে। কারো দায় ছাড়া এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না। চালকের ভারী যাত্রীবাহী বাস চালানোর যোগ্যতা আছে কিনা সেটাই এখন বিবেচনার বিষয়। তবে চালক মোহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় তাকে দিয়ে গাড়ি না চালাতে ঝালকাঠি বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা আমার জানা নেই।

বিআরটিএ ঝালকাঠি-পিরোজপুর জোনের সহকারী পরিচালক ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সদস্য মাহাবুবুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যেই তদন্তের স্বার্থে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, দুর্ঘটনায় আহত, ঘটনাস্থলের লোকজন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছি। চালক মোহনের লাইসেন্স ছিল কিনা এ বিষয়ে বলেন, ২০২০ সালে ইস্যু করা হালকা মটর যান চালানোর লাইসেন্স ছিল তার। বরিশাল থেকে ইস্যু করা প্রাথমিক ড্রাইভিং লাইসেন্স এটি। তিন বছর পার হলে ভারী লাইসেন্স পাওয়ার পর তিনি এ গাড়ি চালাতে পারবেন।  

যাত্রীদের বরাদ দিয়ে তিনি জানান, বাসটির ছাদে ও ভেতরে অতিরিক্ত যাত্রী থাকার কথা জানিয়েছেন তারা। ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা অতিরিক্ত যাত্রীদের সঙ্গে হেলপারের কথা কাটাকাটিও হয়। এ সময় গাড়ির গতি একটু বেশি থাকায় হেলপারের সঙ্গে চালকও পেছন দিকে তাকিয়ে যাত্রীদের কথার জবাব দেন। তখন গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে যায়।

এদিকে বাস দুর্ঘটনার বিষয়ে নিহতদের পরিবার বা স্বজনরা এবং আহতরা কোনো অভিযোগ না করায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। এ বিষয়ে ঝালকাঠি পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানান, বাস দুর্ঘটনায় এতো প্রাণহানি ঘটলেও নিহতদের পরিবার এবং আহতদের কোনো অভিযোগ নেই। ঘটনার পর থেকে বাসের চালক নলছিটির রায়াপুর গ্রামের মোহন (৩৫), হেলপার বরগুনার আশিক ওরফে বুলেট (১৭) ও সুপারভাইজার রাজাপুরের মিজান (২২) পলাতক রয়েছেন। এদের আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা (নং-১৪) দায়ের করেছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।