ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘সড়ক দুর্ঘটনা নয় সুলতানকে পরিকল্পিত হত্যা’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০২৩
‘সড়ক দুর্ঘটনা নয় সুলতানকে পরিকল্পিত হত্যা’

রাজশাহী: ‘কোনো সড়ক দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিতভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল পোশাক কারখানার কর্মী সুলতান আলীকে (৩৫)। আসামি সজল আহমেদের (২৮) স্ত্রীর ওপর কু-নজর পরার পর তাকে ব্ল্যাকমেইল করছিলেন সুলতান আলী।

এজন্য তাকে রাজশাহীতে ডেকে এনে হত্যা করা হয়। বিষয়টি স্বীকার করেছেন মামলার প্রধান আসামি সজল। এ ঘটনার পর সজল ও তার স্ত্রী সুইটি খাতুন ওই সড়ক দুর্ঘটনার নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে মরদেহ উদ্ধারের পর তার ময়নাতদন্তে গলায় ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন মেলে। ’

এছাড়া সুলতান আলীর পকেটে থাকা করোনা টিকার স্লিপের সূত্র ধরে পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে। এক এক করে প্রধান আসামিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রধান আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) রফিকুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা এলাকায় এ হত্যার ঘটনাকে সড়ক দুর্ঘটনার নাটক সাজানো হয়েছিল। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা পায়নি আসামিরা। এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে আরএমপির পবা থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- সজলের স্ত্রী সুইটি খাতুন (২২), বন্ধু সবুজ আলী (২৮) ও চাচা কাওসার আলী (৪২)।

গ্রেপ্তার সজল পবা উপজেলার মহানন্দখালী গ্রামের শহিদুল্লাহর ছেলে ও তার স্ত্রী সুইটি খাতুন। সবুজ আলী রাজশাহীর এয়ারপোর্ট থানার পশ্চিম বাঘাটা গ্রামের মৃত আবেদ আলীর ছেলে। আর কাওসার আলী পবা উপজেলার মহানন্দাখালী গ্রামের মৃত হারুনুর রশিদের ছেলে। আর তাদের মধ্যে প্রধান আসামি সজল আহমেদ ও তার স্ত্রী সুইটি খাতুন পোশাককর্মী সুলতান আলীকে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। তারা এরই মধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রফিকুল আলম বলেন, গত পয়লা জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে নওহাটার দুয়ারীর একটি সড়ক থেকে মধ্যবয়সী অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তিকে গুরুতর জখম অবস্থায় উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। তারা পুলিশের মাধ্যমে গুরুতর আহত ব্যক্তিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পাঠায়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই সময় তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হলেও মরদেহ ট্রাকের নিচে ফেলে সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে হত্যার বিষয়টি উঠে এলে এর গভীর তদন্ত শুরু করে পুলিশ।  

এর আগে মরদেহের প্যান্টের পকেটে করোনার টিকার একটি স্লিপ পাওয়া গিয়েছিল। ওই টিকার স্লিপ দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ মৃতের নাম সুলতান আলী বলে নিশ্চিত হয়।

মরদেহ ময়নাতদন্তের সময় সুলতানের কপালের বাম পাশে ও গলায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। ঘটনার দিনই রামেক হাসপাতাল ফরেনসিক বিভাগে নিহতের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়।  এরপর ২২ জুলাই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পায় পুলিশ। এতে সুলতানকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে এবং তার শরীরে গুরুতর জখম রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।  

এ ঘটনায় ২৪ জুলাই সুলতান আলীর স্ত্রী অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পবা থানায় মামলা করেন। এরপর তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ এ আসামিদের শনাক্ত করে।  

আরএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সহায়তায় অভিযান চালিয়ে নিজ নিজ বাড়ি থেকে এক এক করে চার আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মধ্যে সজল ও তার স্ত্রী সুইটিকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আসামিদের আদালতে সোপর্দ করলে সজল ও সুইটি এ পরিকল্পিত হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

সজল জানান, সুলতান আলী ঢাকার একটি গার্মেন্টসে চাকরির সুবাদে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে সেখানে বসবাস করেন। দুই মাস আগে মোবাইল ফোনে আসামি সজলের স্ত্রী সুইটির সাথে সুলতান আলীর পরিচয় হয়।  পরিচয়ের সূত্র ধরে সুইটির ওপর নজর পড়ে সুলতান আলীর। তিনি প্রায়ই দেখার করার জন্য সুইটিকে প্রস্তাব দেন। সুইটি তার প্রস্তাবে রাজি না হলে সুলতান সুইটির তিন বছরের শিশুর ক্ষতি করার হুমকি দেন।  সুইটি বিষয়টি তার স্বামী সজলকে জানালে সজল সুলতানকে শায়েস্তা করার জন্য পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনানুযায়ী সজল তার স্ত্রী সুইটির মাধ্যমে সুলতানকে রাজশাহীতে দেখা করার জন্য আসতে বলেন। গত পয়লা জুলাই সুলতান সুইটির সঙ্গে দেখা করার জন্য রাজশাহীতে আসেন।

তখন সুইটি তাকে পবা ও তানোর থানার সীমান্তবর্তী নাইস গার্ডেনে নিয়ে যায়। নাইস গার্ডেন তারা পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা মোতাবেক সজল, তার বন্ধু সবুজ ও চাচা আনারুলকে সঙ্গে নিয়ে নাইস গার্ডেনে ঢুকে সুলতানকে জোরপূর্বক অটোরিকশায় তুলে নওহাটার দিকে নিয়ে যায়। এ সময় আসামিরা তাকে মারধর করে এবং তার পরিবারের লোকজনদের আসার জন্য বলতে বলেন। এতে সুলতান রাজি না হলে দুপুর ৩টার দিকে পবা থানার বাগসারা বাজার পার হয়ে ফাঁকা জায়গায় অটোরিকশা ভেতরেই তারা সুলতানের হাত, পা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরে হত্যার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ঘটনার নাটক সাজানো হয়। সেই মোতাবেক তারা রাস্তায় চলন্ত ট্রাক খুঁজতে থাকে।

এ সময় অপরদিক থেকে একটি ট্রাক আসতে দেখে তারা সুলতানের মরদেহ ট্রাকের সামনে ফেলে দেয়। এতে ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সুলতানের মাথায় জখম হলে তারা পালিয়ে যায়। আশপাশের সাধারণ লোকজন ঘটনাস্থলে এসে ট্রাকের সঙ্গে ইজিবাইকের দুর্ঘটনার কারণে সুলতান আহত হয়েছেন বলে মনে করে পুলিশে খবর দেন। এরপর রামেক হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল আলম বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য আসামিকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০২৩
এসএস/এএটি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।