ঢাকা, সোমবার, ২০ মাঘ ১৪৩১, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

সয়াবিন শতভাগ বোতলজাতকরণে কর্মপরিকল্পনা চান ভোক্তার ডিজি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০২৩
সয়াবিন শতভাগ বোতলজাতকরণে কর্মপরিকল্পনা চান ভোক্তার ডিজি ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: গত ১ আগস্ট থেকে বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ ঘোষণা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

কিন্তু সরকারি নির্দেশনার পর এখনও বাজারে বিক্রি হচ্ছে খোলা সয়াবিন তেল।

এমন পরিস্থিতিতে শতভাগ প্যাকেট বা বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারজাত করতে ছয় মাস সময় চেয়েছে পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের সেই অনুরোধ রাখা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি। তবে এটি বাস্তবায়নে আগামী সাত দিনের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা দিতে বলেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

সোমবার (৭ আগস্ট) খোলা সয়াবিন তেল বিপণন ও বিক্রয় বন্ধ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন- ২০০৯ বিষয়ক এক সচেতনতামূলক সভায় সয়াবিন তেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোকে এই কর্মপরিকল্পনা দেওয়ার নির্দেশনা দেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে এই সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করা হয়।

এরআগে, গত ১ আগস্ট সয়াবিন তেল শতভাগ প্যাকেট বা বোতলজাত করতে ছয় মাস সময় চেয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

সভায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ডিজি এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, গত ১ আগস্ট খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের নির্দেশনা দেওয়ার পর বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন আমাদের একটি চিঠি দিয়েছে। সেখানে তারা এই জন্য আরও ছয় মাস সময় চেয়েছেন।

তিনি বলেন, আমরা এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখব। পাশাপাশি আমরা আজকের সভার একটি রিপোর্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানাব। তারপর বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়ে যে নির্দেশনা দেবে, সেটি আমরা পালন করব। পাশাপাশি আমি ভোজ্যতেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনকে অনুরোধ করব, আগামী সাত দিনের মধ্যে সয়াবিন তেল শতভাগ প্যাকজাত করার বিষয়ে তারা তাদের কর্মপরিকল্পনা দিবেন। এই কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা, প্রতি মাসে আপনাদের কারখানাগুলো পরিদর্শনে যাব।

তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সাল ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ সমৃদ্ধকরণ বিষয়ক একটি আইন হয়। এই আইন হওয়ার পর গত কয়েকবছরে ভোজ্যতেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো বোতল বা প্যাকটজাত সয়াবিন তেলে শতভাগ ভিটামিন এ মেশানোর কাজ করছে। এর জন্য যে খরচ হয় সেটিও আমরা ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণের সময় যুক্ত করে দেই। কিন্তু খোলা তেল যে প্রক্রিয়ায় বিক্রি করা হয়, তাতে ভিটামিন এ মেশানো থাকলেও ভোক্তা পর্যায়ে এর উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ খোলা তেলের আমরা ভিটামিন এ পাচ্ছি না। এছাড়া, ২০১৯ সালে আরেকটি আইন হয়, যেখানে ভোজ্যতেল সম্পূর্ণ প্যাকেট বা বোতলজাত করার কথা বলা হয়েছে। এরপর থেকে তিন-চার বছর ধরে এটি নিয়ে কাজ হচ্ছে।

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, খোলা তেল যে প্রক্রিয়ায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আসে, সেখানে নীল ড্রাম ব্যবহার করা হয়। এসব ড্রামে ২০৪ থেকে ২১০ লিটারের মতো তেল থাকে। এসব ড্রামগুলো মূলত কেমিকেলের ড্রাম। এছাড়া এসব ড্রাম থেকে যেভাবে তেল পাম্প করে বোতলে ভরা হয় সেটি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত? এগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই সয়াবিন ও পাম তেল শতভাগ প্যাকেট বা বোতলজাত করতে হবে, এই জন্যই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এর জন্য ইন্ডাস্ট্রিগুলোরও প্রস্তুতি লাগবে। সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম।

তিনি বলেন, গত ১৮ বা ২০ জুলাইয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জাতীয় কমিটির একটি মিটিং হয়। সেই মিটিংয়ে ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে যারা এসেছেন, তারা বলেছেন, সয়াবিন তেল শতভাগ প্যাকেট বা বোতলজাত করে বাজারে পরিবেশন করার জন্য তারা প্রস্তুত। তারই প্রেক্ষিতে গত ১ আগস্ট আমরা খোলা তেল ধীরে ধীরে বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। কিন্তু বাজারে আমরা এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখলাম, তাদের প্রস্তুতির কিছু ঘাটতি আছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ভোজ্যতেলের ৭০ শতাংশ পাম তেল এবং ৩০ শতাংশ সয়াবিন তেল। সয়াবিন তেলের প্রায় অর্ধেক খোলা বিক্রি হয় এবং অর্ধেক প্যাকেটজাত হয়ে বিক্রি হয়। কিন্তু আমরা খুচরা পর্যায়ের খোলা সয়াবিন তেল পরীক্ষা করে দেখেছি, অনেকক্ষেত্রে সুপার পাম তেল সয়াবিন হিসেবে বিক্রি হচ্ছে, পাম তেল বিক্রি হচ্ছে সুপার পাম বলে। এভাবে ভোক্তাদেরকে প্রতারিত করা হচ্ছে। কারণ খোলা তেলে কোম্পানির নাম, মেয়াদ এবং পাম না সুপার সেটি লেখা থাকে না।

ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি বলেন, বোতলজাত তেলের ক্ষেত্রে আমরা মনিটরিংটা জোরদার করতে পারি। কারণ এখানে মূল্য, কোম্পানির নাম, ব্র্যান্ডের নাম, মেয়াদ লেখা থাকে। সেখানে বোতলের গায়ে লেখা মূল্যের থেকে বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ নেই। কিন্তু খোলা তেলে সেটি মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, খোলা তেলের সব কোম্পানির ড্রাম একই রকম।

তিনি বলেন, সয়াবিন তেল শতভাগ প্যাকেট বা বোতলজাত করতে হবে। সেটা ২০০, ২৫০ বা ৫০০ মিলিলিটারের পাউস প্যাক হলেও করতে হবে। একটি সময় খোলা সয়াবিন তেল আমরা পুরোপুরি মার্কেট থেকে তুলে নিব। সেটি মূল কাজটি করতে হবে মিল ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সেখানে যদি আমরা শতভাগ প্যাকজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে খুচরা বিক্রেতারাও প্যাকেটজাত সয়াবিন তেল বিক্রি করবে।

তিনি আরও বলেন, গত ১ আগস্ট খোলা তেল বিক্রি বন্ধের যে কার্যক্রমটি নিয়েছি, সেটি গ্রহণ করার এক সপ্তাহ আগে অংশীদারদের (রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান, মিল মালিক, বড় বড় ব্যবসায়ী, বাজার সমিতি) সবাইকে জানিয়েছি। তার পরিপ্রেক্ষিতে মিলগুলো থেকে জানানো হয়, তারা প্রস্তুত না। এর জন্য কয়েকবার সময় বাড়ানোর পর জাতীয় কমিটির মিটিংয়ে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সয়াবিন তেল প্যাকেট করার জন্য তারা প্রস্তুত। তারপরও ১ আগস্টের পর খোলা তেল রাখায় কাউকে ধরপাকড় বা জরিমানা করা হয়নি।

সভায় সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, ভোজ্যতেল খোলা বিক্রি করব না, এই বিষয়ে আমাদের কারও দ্বিমত নেই। অনেকদিন ধরে আমরা ভোজ্যতেল কীভাবে প্যাকেটজাত করা যায়, সেটি চেষ্টা করছি। বাস্তবতা হলো, আমাদের কিছু মিল অনেক এগিয়ে গেছে। কিছু মিল হয়তো আগামী ছয় মাসের মধ্যে শতভাগ প্যাকেটজাত ভোজ্যতেল সরবরাহ করতে পারবে। একটি মিল আছে যাদের আরও একটু বেশি সময় লাগবে। এজন্য আমরা ছয় মাস সময় চেয়েছি।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, মিল মালিকরা যদি অঙ্গীকারবদ্ধ হন, তাহলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে যেতে পারব। পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আমরা যদি একটি টিম হিসেবে কাজ করি, তাহলে আমরা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাব। আমরা চাই, আপনারা এই বিষয়ে আপনাদের একটি পরিকল্পনা দেবেন। তখন আমরা সেটি মনিটরিং করব।

এস. আলম গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে আমাদের দৈনিক প্যাকিংয়ের সামর্থ্য ৫০ থেকে ৬০ টন। এটাকে আমরা বাড়িয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টন করতে পারছি। কিন্তু আমাদের প্রতিদিন মার্কেটে তেল সরবরাহ করতে হয় এক হাজার টন। এটা আগামী এক বছরে হয়তো দুই থেকে তিন হাজার টন হবে। কিন্তু এত তেল প্যাকিং করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। যার কারণে শতভাগ প্যাকেটজাত তেল বিক্রি করা খুবই কঠিন। এটি বাস্তবসম্মত না। তার থেকে ড্রামের তেলে সঠিক মাত্রায় ভিটামিন এ বা অন্যান্য উপাদান আছে কিনা সেটি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা দরকার।

মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার বলেন, সয়াবিন পুরোপুরি প্যাকেটজাত করার জন্য আমাদের সময় দিতে হবে। ধীরে ধীরে ভোক্তারাই প্যাকেটজাত তেলের দিকে যাবে। কিন্তু এর আগে যদি আমরা জোর করে খোলা তেল বন্ধ করে দেই, তাহলে সাপ্লাই চেইনে সমস্যা দেখা দিবে।

টিকে গ্রুপের ভিজিএম অ্যাকাউন্ট নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে প্যাকিং মেশিনারিজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কেউ এলসি করেছে, কারও চলে এসেছে, কেউবা আবার অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করছে। কিন্তু একটাকে পুরোপুরি বন্ধ করে আরেকটাকে চালু করা খুবই কঠিন হবে।

বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী মো. গোলাম মাওলা বলেন, আমরা দীর্ঘ বছর ধরে খোলা তেলের ব্যবসা করে আসছি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৪-৫ লাখ ব্যবসায়ী এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। হঠাৎ খোলা তেল বন্ধ করে দিলে আমাদের ব্যবসার কি হবে? তার থেকে যেখান থেকে তেলগুলো রিফাইনারি হয়ে আসে, সেখানেই যদি ভিটামিন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে আমরা ব্যবসা করে খেতে পারব।

এ সময় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান আব্দুল জব্বার মণ্ডল, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপ-প্রধান মাহমুদুল হাসান, বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক মনির হোসেন, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রোগ্রাম কর্ডিনেটর আহমেদ ইকরামুল্লাহ, এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি ও কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০২৩
এসসি/এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।