ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ মাঘ ১৪৩১, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

বাংলানিউজে সংবাদ প্রকাশ

৬ কোটি টাকা হজম করতে সিলেটের সেই সড়কে তড়িঘড়ি কাজ!

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০২৩
৬ কোটি টাকা হজম করতে সিলেটের সেই সড়কে তড়িঘড়ি কাজ! ছবি: বাংলানিউজ

সিলেট: ভয়ঙ্কর অনিয়ম ধরা পড়েছে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ-রাজনগর-মৌলভীবাজার সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে। কোনো কাজ না করেই প্রকল্পের সম্পূর্ণ অর্থ ছাড় দেওয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে কাজ সম্পন্ন করার সনদ দিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

গত ১৭ আগস্ট ‘কাজ না করেই সরকারি অর্থ লোপাট’ শিরোনামে বাংলানিউজে সংবাদ প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) ও তাদের অধীনস্থ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা’।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত তিন দিন থেকে তড়িঘড়ি করে ওই সড়কের চার কিলোমিটার কাজের মধ্যে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মির্জাপুর থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ টোল প্লাজা পর্যন্ত এক কিলোমিটার সড়কের কাজ সম্পন্নের চেষ্টা করছে। অথচ এই প্রকল্পের কাজের অর্থ ছাড় দেওয়া হয়েছে গত ২২ জুন।

বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, ওই সড়কের মির্জাপুর থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ টোল প্লাজা পর্যন্ত সড়কে কাজ শুরু করেছে সওজ। কাজের সময় শেষ ও অর্থ তুলে নেওয়ার পর বৃষ্টির মধ্যে তড়িঘড়ি করে ওয়্যারিং কোর্স সম্পন্ন করা হচ্ছে।

তবে বৃষ্টির মধ্যে বিটুমিনের কাজ করায় গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি থেকে কাজের সাব লিজ নেওয়া জয়দ্বীপ দে পার্থ’র তত্ত্বাবধানে কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সাইটে কর্মরত জনসন দাস।

এদিন দুপুরে রাস্তার বিটুমিন ও ওয়্যারিং কোর্সের কাজ চলাকালীন সময় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। অথচ বিটুমিনের প্রধান শত্রু বৃষ্টি।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেঞ্চুগঞ্জ বণিক সমিতির সদস্য দাহিরুল ইসলাম রানা বাংলানিউজকে বলেন, বৃষ্টির সময় রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করলে টেকসই হয় না। কিন্তু গত তিন দিন ধরে বৃষ্টির মধ্যে কাজ করা হচ্ছে। কেবল গা বাঁচাতে তারা নিয়ম না মেনে এখন কাজ করছে। বৃষ্টির মধ্যে গ্যারাটিন দিয়ে রাস্তার কাজ করা হচ্ছে। সাইড প্রোটেকশন না থাকায় পিচ ঢালাইও টিকবে না। এ কথা কারও কাছে বলতেও পারছি না, সইতেও পারছি না।

ফেঞ্চুগঞ্জ ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আছকির আলী বলেন, তড়িঘড়ি করে বৃষ্টির মধ্যেও কাজ করা দেখে নিষেধ করা হলেও তারা শোনেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার কাজ করতে দেখিনি। কেননা, বিটুমিনের প্রধান শত্রু বৃষ্টি। আমরা সাইট প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েও পারিনি।

কাজের সাইটে থাকা সওজের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সাইদুর রহমান বলেন, বৃষ্টির কারণে সময়মত কাজ করা যায়নি, এখন করা হচ্ছে। যদিও কাজের টাকা ছাড় কিংবা কাজ সম্পন্নের সনদ প্রদানের পর কাজ শুরুর প্রশ্নে তিনি সঠিক উত্তর না দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করেন।

বৃহস্পতিবার কাজ পরিদর্শনকালে জনৈক জনসন দাস প্রথমে নিজেকে ঠিকাদার ও পরে কলেজছাত্র দাবি করেন। এক পর্যায়ে তিনি ঠিকাদার থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে প্রতিদিন এক হাজার টাকার বিনিময়ে সাইটে কাজ করছেন বলেন জানান।

সড়কের কাজের অনিয়মের বিষয়ে জানতে সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে ফোনে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এ সম্পর্কে অবহিত নন জানিয়ে অফিসে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। যদিও তখন কাজের তদারকিতে ছিলেন সওজ’র মোগলাবাজার-বিশ্বনাথ সড়ক উপবিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান।

সওজ সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে ওই সড়কে চার কিলোমিটার মেরামতে খাগড়াছড়ির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। গত বছরের অক্টোবরে কাজ শুরুর কথা প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু নিজে কাজ না করে সিলেটের ঠিকাদার জয়দ্বীপ দে পার্থ ও মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জয়দ্বীপ সিলেট সড়ক সার্কেলের সদ্য বদলি হওয়া তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উৎপল সামন্তর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
 
প্রকল্পটির কোনো কাজ না হলেও ২২ জুন চূড়ান্ত বিল ছয় কোটি টাকা অনুমোদন দেয় সড়ক বিভাগ। সওজ থেকে দেওয়া হয় কাজ সম্পন্ন করার সনদও। এতে সাক্ষর রয়েছে সিলেট সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. ফজলে রাব্বিরও। তিনি ১৫ জুন এই সনদে সাক্ষর করেন।

বাংলানিউজে গত ১৭ আগস্ট সংবাদ প্রকাশের পর তিন দিন ধরে রাস্তার কাজ করছেন ঠিকাদার। কাজ না করে চূড়ান্ত সনদ দেওয়া ও সরকারি অর্থ ছাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনায় কর্মকর্তা থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সবাই জড়িত।

দেখা যায়, পিএমপি (সড়ক ও মেজর) এর অর্থ ছাড়করণের জন্য সংযুক্ত চেকলিস্টে সাক্ষর রয়েছে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (চ.দা.) মো. মাহমুদুল হাসান ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমানের। তারা ১৩ জুন চেক লিস্টে সাক্ষর করেন।

জানা গেছে, সড়কের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন আইটেম ধরা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। যেখানে বেইজমিক্স প্লান্ট বাধ্যতামূলক ছিল, তিন দিন ধরে শুরু হওয়া কাজে সেখানে ড্রাম মিক্সড প্লান্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। বাইন্ডার কোর্স না করেই ওয়্যারিং কোর্স করা হচ্ছে। রাস্তা প্রশস্তকরণ করণ অংশেও বাইন্ডার করা হয়নি। শুধু বেইস টাইপ করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জনৈক ঠিকাদার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই প্রকল্পের আরও দুটি অংশে মেয়াদ শেষের দুই মাস পরও কাজ শুরু হয়নি। এরমধ্যে এই সড়কের ইলাশপুরে দুই কিলোমিটার ওয়্যারিং কোর্স ও খালেরমুখ এলাকায় এক কিলোমিটার ওয়্যারিং কোর্স এবং ফেঞ্চুগঞ্জ ব্রিজের এক কিলোমিটার অ্যাপ্রোচে ওয়্যারিং কাজ শুরুই হয়নি। এগুলো আগামী দুইএকদিনের মধ্যে শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে।

২০২২ সালের ২১ অক্টোবর সম্প্রসারিত রাস্তার মেরামত কাজের উদ্বোধন করেন সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ছয় কোটি টাকার এ কাজ চলতি বছরের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু কাজ না করেই তড়িঘড়ি করে সম্পূর্ণ অর্থ ছাড় দেওয়া হয়। যদিও চুক্তি অনুযায়ী মেয়াদকালের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করা বাধ্যতামূলক। অন্যথায় প্রকল্প ব্যর্থ/বাতিল হওয়ার কথা।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০২৩
এনইউ/এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।