বগুড়া: দীর্ঘ এক যুগ ধরে বগুড়া ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) ছাত্রাবাসে থাকেন ছাত্রলীগ নেতা সজল ঘোষ। ছাত্র না হয়েও হলের শিক্ষার্থীদের মারধর, সিট বাণিজ্য, মাদক সেবন, মেয়ে নিয়ে ফুর্তি; পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটা টাকা আদায়- কি করেন না তিনি।
শিক্ষার্থীদের দিয়ে হাত-পা টেপানো; কথা না শুনলে গালমন্দ, পান থেকে চুন খসলে চড়-থাপ্পড়-লাথি দেওয়া- তার অপকাণ্ড চলছিল বিনা বাধায়। বিনা সিংহাসনের এ রাজার ভয়ে তটস্থ থাকতেন শিক্ষকরাও। কার্যত ক্ষমতার প্রভাবে সবািইকে জিম্মি করে রেখেছিলেন সজল ঘোষ।
কথায় আছে অকর্মা নাপিতের থলিভরা ক্ষুরে থাকে না ধার বেশি দিন; তেমনি হয়েছে সজলের। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা তার এসব কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারছেন না। মনের ক্ষোভ আর রাগের বাঁধ ভেঙেছে তাদের। অবস্থা বেগতিক আর শিক্ষার্থীদের উত্তাল স্লোগান শুনে আইএইচটি থেকে পালিয়ে গেছেন ছাত্রলীগ নেতা সজল ঘোষ।
জানা গেছে, সজল ঘোষ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। বগুড়ার বেসরকারি একটি ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাস করেন তিনি। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে বেশ কয়েক বছর আগে আইএইচটির ছাত্রাবাসে এসে ওঠেন তিনি। সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে প্রতিষ্ঠানের ‘রাজা’ বনে যান তিনি।
এতদিন সাধারণ শিক্ষার্থীরা মুখ বুজে সব সহ্য করলেও মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) আর করেনি। এদিন সজলের লেজে পাড়া দিয়ে ধরেন তারা। ঘটনাটি ঘটে দুপুরে। ছাত্রাবাসে বাকি খেতেন সজল। টাকার সংকট পড়ায় সেখানকার মিল ম্যানেজার আমিনুল তার সঙ্গে কথা বলতে যান। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আমিনুলকে মারধর করেন সজল ঘোষ। পরে দ্রুত এ খবর অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে নিজের সমূহ বিপদের কথা আঁচ করতে পেরে আইএইচটির প্রাচীর টপকে পালান সজল।
অপকাণ্ডে ভরা ছাত্রলীগ নেতাকে ছাত্রাবাস বা ক্যাম্পাস এলাকায় না পেয়ে শিক্ষার্থীরা রাতে আইএনচটির সামনে শহরের প্রধান সড়কে অবরোধ করেন। তারা সজলের বিচারের দাবিতে স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে পুলিশ।
আইএইচটির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমন কেউ নেই যে সজলের মারধরের শিকার হয়নি। পান থেকে চুন খসলেই মারতো। আমাকেও মেরেছে। অথচ তার সঙ্গে সব সময় থেকেছি। সজল ঘোষ এখানকার শিক্ষার্থীই না। অথচ সে ২২৮ নম্বর রুমে থাকতো। সবাইকে দিয়ে হাত-পা টেপাতো। কলেজ অধ্যক্ষ সব কিছু জানেন। কিন্তু তিনি আরও প্রশ্রয় দিতেন সজল ঘোষকে।
বিক্ষোভরত আরও একাধিক শিক্ষার্থীও একই অভিযোগ করেন। তাদের দাবি, কথা না শুনলেই সজল শিক্ষার্থীদের মারতো। ছুরি, চাকু পেটে ঠেকিয়ে ভয় দেখাত। আর হোস্টেলে বসে মিলের টাকা মেরে খেত। কলেজে তার কথামতো কিছু না হলেই নির্যাতন চালাতো সজল ঘোষ।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমিনুলকে মারধরের ঘটনা আমরা সহ্য করতে পারিনি। আমরা বিক্ষোভ শুরু করলে সুযোগ পেয়ে নিজেকে রাজা দাবি করা ছাত্রলীগ নেতা সজল ঘোষ আইএইচটির পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির রেডিওলজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী বাছেদ আহমেদও সজলের নির্যাতনের শিকার। তিনি জানান, ১৫ থেকে ১৬ দিন আগে ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু তার একটু দেরি হয়। এ জন্য সজল তাকে প্রচণ্ড মারধর করে। বাছেদ বলেন, অথচ আমি কলেজের ছাত্রলীগের একজন কর্মী। কিন্তু তিনি এই কলেজের কেউ না।
জাফর সিদ্দিক নামে শেষ বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের খাওয়ার জন্য হোস্টেলে প্রতি মাসে ২২০০ টাকা নেওয়া হয়। আর গ্যাস বিল ১৫০ টাকা। অথচ ওরা আলুঘাটি ছাড়া আর কিছু খাওয়ায় না। সব টাকা সজল নিয়ে যেত।
আরও অভিযোগ রয়েছে সজল ও তার বন্ধুদের নিয়ে। ক্যাম্পাসের মাঠে তারা ছাড়া আর কেউ খেলাধুলা করতে পারে না। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বনভোজনের নামে-বেনামে চাঁদা নেন সজল। হলের ডাইনিং নিয়ন্ত্রণ করেন। হলের মধ্যেই আবাসিক শিক্ষার্থীদের মিল (খাবার) খেতে বাধ্য করতেন।
আইএইচটিতে ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের হল বরাদ্দ দেওয়া হয়। হলে থাকলে হলে প্রত্যেক ছাত্রকে ৩ বছরের জন্য এককালীন ১২ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। তবে কোনো শিক্ষার্থী হল থেকে বের হয়ে গেলে তাকে কোনো অর্থ ফেরত দেওয়া হয় না। এর সুযোগ নিয়ে হল বাণিজ্য করতেন সজল। নতুন শিক্ষার্থীকে হলে তোলার জন্য তার কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায় করতেন।
আইএইচটি সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের জন্য ১৯৭৮ সালে দুটি আবাসিক হোস্টেল চালু হয়। এর মধ্যে একটি ছাত্রদের, অন্যটি ছাত্রীদের। প্রথমে এটি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতেন। সে সময় ম্যাটসের কার্যক্রমের জন্য এখানে কিছু ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৯২ সালে থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরে এই মেডিকেল কলেজ নতুন ভবনে স্থানান্তর হয়। এরপর এখানে আইএসটির কার্যক্রম শুরু হয়।
চারতলা হলটিতে মোট ৭২টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষে দুজন শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সে হিসেবে মোট ১৪৪ শিক্ষার্থীর থাকার জায়গা রয়েছে। হলের সিট বাণিজ্য করেন সজল। একটি সিটের জন্য এককালীন ৫-১০ হাজার টাকা নিতেন। ২০১৮ সালের দিকে তার অত্যাচারে হোস্টেল ছাড়তে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
হলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবন করতেন ছাত্রলীগ নেতা সজল। মেয়ে নিয়ে এসে ফুর্তি করতেন। এমন বহু ঘটনার সাক্ষী ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা। কয়েকজন শিক্ষার্থী সজলের বিরুদ্ধে পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটা টাকা আদায়ের অভিযোগও তুলেছেন।
এসব ব্যাপারে জানতে সজলের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ সম্ভব হয়নি কেননা তিনি পালিয়ে গেছেন। তার মোবাইলে নম্বরও বন্ধ।
শিক্ষার্থীদের এত অভিযোগের বিষয়ে নাকি জানতেন না আইএইচটির নীতিনির্ধারকরা। প্রতিষ্ঠানটির হোস্টেল সহকারী মোখলেছুর রহমান বলেন, সজল কখনই আমাদের শিক্ষার্থী ছিল না। তার বিষয়ে ছাত্ররা কখনো অভিযোগও দেয়নি। ও রাজনীতি করে, কথা বলাই তো টাফ হয়ে যায়। রাজনীতির প্রভাব দিয়েই আইএইচটিতে প্রবেশ করেছে সে।
আইএইচটির অধ্যক্ষ ডা. আমায়াত-উল-হাসিন বলেন, সজল হোস্টেলের শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করে- আমি জানি না। বনভোজনের নামে টাকা নিয়েছে- এটাও আমি জানি না। তবে শিক্ষার্থীরা যদি আগে আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিত, আমি ব্যবস্থা নিতাম।
তাদের বক্তব্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের দাবি, উনারা সবই জানেন, সবই বোঝেন। কোনো এক কারণে নিজেদের সেফ করতে তারা সজলের বিরুদ্ধে কথা বলছেন না।
এ বিষয়ে জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম বলেন, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তির কাছে জিম্মি হবে এটা কখনই কাম্য না। আইএইচটির শিক্ষার্থীরা সজল নামে ছাত্রলীগের এক নেতাকে আটকের দাবি করে সড়কে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাদের বেশ কিছু সমস্যার কথা জানতে পেরেছি। তারা প্রিন্সিপালকে এসব সমস্যার কথা জানিয়েছে। প্রিন্সিপাল আমাদের জানিয়েছেন তারা এসব সমস্যা সমাধান করবেন। আমরাও আমাদের দিক থেকে সহায়তা করব।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০২০
এমজে