ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

ধনীরা আইনকে পিষে ফেললে বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলে না: প্রধান বিচারপতি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০২৩
ধনীরা আইনকে পিষে ফেললে বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলে না: প্রধান বিচারপতি

ঢাকা: শেষ বিচার কর্মদিবসে আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এ সময় ধনীরা আইনকে পিষে ফেললে বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, আমাদের প্রতিটি আইনে মানবিকতার স্পর্শ থাকতে হবে। আইন যদি দরিদ্রকে পিষে দেয় আর ধনী ব্যক্তি যদি আইনকে পিষে দেয় তাহলে রাষ্ট্র এবং বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলছে এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা আর বিচারকদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হাওয়া থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে, সংবিধান, আইন নিজেদের বিচারিক বিবেকের প্রতি পরিপূর্ণ অনুগত থেকে বিচার কার্য সমাধান করা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় জনগণের অগাধ আস্থা স্থাপন করতে হবে এবং থাকতে হবে নইলে জনগণের অধিকার রক্ষা হবেনা এবং স্বাধীনতাও বিপন্ন হবে। সব বিচারককে অসামান্য নৈতিকতার অধিকারী হতে হবে, নইলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা শুধুমাত্র সংবিধানের ভিতরই আবদ্ধ থাকবে। ধন্য তারাই, যারা অন্তরে শুদ্ধ।

বৃহস্পতিবার (৩১ আগস্ট) বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবেসে অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির বিদায়ী সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এসব কথা বলেন।

নিজ বক্তব্যের শুরুতে প্রধান বিচারপতি বলেন, রাজনৈতিক বিভক্তি রাজপথ ছেড়ে বিচারালয়ের দিকে ধাবিত হলে সেটা বিচারালয়ের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। আর আইনজীবীদের বিভক্তি ও মতভেদ ও তার প্রতিক্রিয়া বিচারালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

আস্থা হারালে জাতিকে খারাপ দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, বিচার বিভাগ প্রজাতন্ত্রের হৃদপিণ্ড। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের দক্ষতার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আর কোনো উপযুক্ত পরীক্ষা নেই। জনগণ শাসন বিভাগ বা আইন বিভাগের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারালে সে জাতিকে খারাপ দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আইনের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বা প্রাধান্য কার্যকর করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগ যদি আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ বা পিছপা হয় তাহলে রাষ্ট্র এবং নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। বিচার বিভাগ সংবিধানের আধিপত্য রক্ষার পাশাপাশি জনগণের মৌলিক অধিকারের রক্ষক। সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন সংরক্ষণ এবং সমাজের দুর্বল অংশের অধিকার এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য্য।

সাংবিধানিক বিধানের মজবুত দেয়াল দিয়ে সর্ব প্রকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করার দায়িত্ব বিচারকদের, আইনজীবীদের এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেক দায়িত্বশীল নাগরিকের। আমরা, আপনারা, সবাই সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সর্বনাশা দিনের জন্য প্রতিটি নাগরিকের অপেক্ষা করতে হবে।

রাজনৈতিক বিভক্তি বিচারালয়ে আসা মঙ্গলজনক হয় না
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, রাজনৈতিক বিভক্তি রাজপথ অতিক্রম করে বিচারালয় অভিমুখে ধাবিত হলে সেটা বিচারলয়ের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, আইনজীবীদের বিভক্তি ও মতভেদ এবং তার প্রতিক্রিয়া বিচারালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাজনৈতিক মতাদর্শ রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়ন করলে এবং বিচারলয়কে নিরাপদ দূরত্বে রাখলে বিচার বিভাগ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

ব্যর্থ হলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না
সংবিধান প্রণেতারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করেছেন, সে স্বাধীনতা কার্যকর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের এবং প্রতিটি নাগরিকের। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে একাত্তরের রক্ত বৃথা যাবে। মনে রাখতে হবে জনগণের ঐক্যবদ্ধ বীরত্ব এবং সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দেশ, এই বিচারালয় পেয়েছি। একাত্তরে জাতি চরম ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছে। আমাদের জাতীয় দায়িত্ব হলো সর্বক্ষেত্রে সেই দেশকে এগিয়ে নেওয়া। আমরা ব্যর্থ হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

এ সময় প্রতিটি আইনে মানবিকতার স্পর্শ; ধনীরা আইনকে বা আইন যদি দরিদ্রকে পিষে দেয় রাষ্ট্র বা বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলছে বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আমাদের বিচার বিভাগ শক্তিশালী বিচার বিভাগগুলোর অন্যতম
হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আরও বলেন, আমি সবসময় মনে করেছি আমি বাংলার, বাংলা আমার এবং আমি মুসলিম, আমি বাঙালি আর একাত্তর আমার প্রেরণা। আমি চেষ্টা করেছি জনগণের ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষাকে আমার কাজের মধ্যে প্রতিফলন ঘটাতে। জুডিসিয়ারিকে সুশৃঙ্খল এবং গতিশীল করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমাদের বিচার বিভাগ পৃথিবীতে শক্তিশালী বিচার বিভাগগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশকে বসবাসের জন্য আরও ভালো জায়গা করার লক্ষ্যে জনগণ যাতে স্বল্প খরচে স্বল্প সময়ে ন্যায় বিচার পায় তার জন্য আমার বিচারকদের উদ্বুদ্ধ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি বিচারপ্রার্থী অভাগা মানুষগুলো আদালত প্রাঙ্গণে এসে একটু স্বস্তিতে বসতে পারে তার ব্যবস্থা করতে। বিচারকদের বুঝাতে চেষ্টা করেছি সর্বশক্তিমান আল্লাহ-তায়ালা মানুষের বিচারিক সেবা দেবার জন্যই বিচারকের দায়িত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রে আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও ন্যায়কুঞ্জের জন্য, রেকর্ড ভবনের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

রাজনীতিবিদ আইনজীবীগণকে অনুরোধ
প্রধান বিচারপতি রাজনীতিবিদ আইনজীবীদের অনুরোধ করে বলেন, বিচারালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাষ্ট্র সৃষ্টিতে ত্যাগের কথা অন্তত ১০ বার ভাববেন, কারণ আপনাদের সিদ্ধান্তে ভুল হলে শেষ বিচারে তাতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়। ক্ষতি হয় বিচার বিভাগের। বিজ্ঞ আইনজীবীদের সেই শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে, যে শক্তি বিচারালয়কে দুর্বল করে, যে শক্তি গণতান্ত্রিক জীবন-যাপন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

আপিল বিভাগের এক নম্বর বিচার কক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির প্রধান বিচারপতিকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেন।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২১
ইএস/এমএম/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।