ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

প্রবাসীদের টিকিটের প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে মালামাল পাঠাতো চক্রটি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০২৩
প্রবাসীদের টিকিটের প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে মালামাল পাঠাতো চক্রটি

ঢাকা: অভিনব কায়দায় প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনদের জিম্মি করে অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিদেশ থেকে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান পণ্য বাংলাদেশে নিয়ে আসা একটি চক্রের মূলহোতা খোরশেদ আলমসহ তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। সেইসঙ্গে অপহৃত একজন ভুক্তভোগীকেও উদ্ধার করা হয়েছে।

 

 বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) ভোর পর্যন্ত রাজধানীর রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়৷ 

শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) দুপুরে ১২ টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।  

খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেপ্তার বাকি আসামিরা হলেন- জুয়েল রানা মজুমদার (৪০) এবং মাসুম আহমেদ (৩৫)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রসাধনী, অন্যান্য মূল্যবান পণ্যসামগ্রী উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা।

তিনি বলেন, গত ৯ অক্টোবর রাতে যশোরের চৌগাছা থেকে সৈয়দ আলী মণ্ডল (৬৫) নামে এক ব্যক্তি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে প্রবাস ফেরত তার ছেলেকে নেওয়ার জন্য রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এসে নিখোঁজ হন। ভুক্তভোগীর পরিবার সম্ভাব্য সকল জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে তাকে না পেয়ে ভুক্তভোগীর জামাতা রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি- নং-১০২৭) করেন।  

এছাড়াও ভুক্তভোগীর পরিবার র‌্যাব-৪ এর কাছে একটি অভিযোগ জানান। র‌্যাব ওই নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একটি বাসায় অভিযান পরিচালনা করে নিখোঁজ ও অপহৃত ভুক্তভোগী সৈয়দ আলী মণ্ডলকে উদ্ধার র‌্যাব-৩ এবং র‌্যাব-৪ এর যৌথ একটি দল। ওই বাসা থেকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত চক্রের মূলহোতা খোরশেদ আলম ও তার দুই সহযোগী জুয়েল রানা মজুমদার, মাসুম আহমেদকে গ্রেপ্তার করে।  

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আসামিরা অপহরণের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছে।  

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানান, ভুক্তভোগী সৈয়দ আলীর ছেলে প্রবাসী নুরুন্নবী গত ২০ আগস্ট উন্নত জীবন যাপনের আশায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যান। বিদেশে যাওয়ার পর সেখানে ভালো চাকরি ও সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় একপর্যায়ে দেশে ফেরত আসার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় প্রবাসে এই চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফ এবং তার সহযোগীরা নুরুন্নবীর আর্থিক দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাকে বাংলাদেশে আসার ফ্রি টিকিট দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে স্বর্ণালংকার এবং একটি লাগেজে বেশকিছু দামি কসমেটিক্স, ইলেকট্রনিকস আইটেম, চকলেট ইত্যাদি বাংলাদেশে নিয়ে এসে গ্রেপ্তার খোরশেদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে বলে শর্ত দেয়।  

প্রবাসী নুরুন্নবী তাদের দেওয়া শর্ত মেনে ৯ অক্টোবর রাতে ঢাকায় আসবেন বলে তার পরিবারকে জানান। প্রবাসী নুরুন্নবীর বাবা ভুক্তভোগী সৈয়দ আলী ৯ অক্টোবর রাতে প্রবাস ফেরত ছেলেকে নেওয়ার জন্য ঢাকায় এলে চক্রের সদস্যরা তাদের পাঠানো পণ্য নিরাপদে পাওয়ার জন্য জামানত হিসেবে ভুক্তভোগী সৈয়দ আলীকে কৌশলে রাজধানীর শান্তিনগরের একটি বাসায় নিয়ে জিম্মি করে রাখেন।  

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, এই চক্রটি বাংলাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী আরো বেশকয়েকজন দুষ্কৃতকারী বাংলাদেশিদের পরস্পর যোগসাজশে প্রবাস ফেরত বিভিন্ন যাত্রীদের মাধ্যমে বিগত ৫-৬ বছর ধরে কৌশলে অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে মূল্যবান পণ্য দেশে এনে বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করে আসছিলেন। এই চক্রটির অন্যতম মূলহোতা আবু ইউসুফ মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসী। দেশে ও বিদেশে এই চক্রটির প্রায় ১২-১৫ জন সদস্য রয়েছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রবাসীদের গ্রুপসহ বিভিন্ন স্থানে ফ্রি টিকিটে বাংলাদেশে আসার প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকেন। এসব বিজ্ঞাপন দেখে যে সব প্রবাসী ফ্রি টিকিটে দেশে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তাদেরকে চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফ ফ্রি টিকিট দেওয়ার বিনিময়ে প্রত্যেক প্রবাসী ব্যক্তির কাছে স্বর্ণ, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রীসহ দামি প্রসাধনী ২৫ থেকে ৩০ কেজির ওজনের একটি লাগেজ ধরিয়ে দেন। প্রতিটি লাগেজে আনুমানিক ১০-১৫ লাখ টাকা মূল্যের পণ্য থাকে বলে জানা যায়।  

এছাড়াও যারা ফ্রি টিকিটে দেশে আসতে চায় প্রথমে তাদের পাসপোর্ট এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক নথিপত্র চক্রটি নিজেদের জিম্মায় নেয় এবং প্রকৃতপক্ষে তারা দেশে আসবেন কিনা এ বিষয়ে নিশ্চিত হোয়ার জন্য বাংলাদেশে থাকা চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে টার্গেটকৃত প্রবাসীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রবাসী ব্যক্তির দেশে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হন।

এই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, প্রবাসী ব্যক্তি দেশে আসার আগের দিন চক্রের সদস্যরা কৌশলে প্রবাসী ব্যক্তিকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয় এবং একটি লাগেজে করে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন প্রকার দামি ইলেকট্রনিক্স আইটেম এবং প্রসাধনী সামগ্রী দেয় যেগুলো বাংলাদেশে থাকা চক্রের অপর সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করতে হয়।  

প্রবাসীর আত্মীয়-স্বজন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কৌশলে চক্রটি তাদেরকেও ঢাকায় এনে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে তাদের পরিচিত ও আগে থেকে নির্ধারিত বাসায় নিয়ে জিম্মি করে রাখে। প্রবাসী ব্যক্তির ফ্লাইট ঢাকায় অবতরণ করার কয়েক ঘণ্টা আগে চক্রের কয়েকজন সদস্য বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। পরে প্রবাসী যাত্রী বাংলাদেশে পৌঁছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা মালামালপূর্ণ লাগেজ চক্রের সদস্যদের কাছে যথাযথভাবে হস্তান্তর করলেই জিম্মিকৃত আত্মীয়দের ছেড়ে দেওয়া হয়। চক্রটি নিজেদের গোপনীয়তার স্বার্থে ২-৩ মাসের মধ্যেই ভাড়া বাসা পরিবর্তন করে থাকে।  

খন্দকার আল মঈন বলেন, যেই ভাড়া বাসা থেকে ভুক্তভোগী সৈয়দ আলীকে উদ্ধার করা হয় সেই বাসাটিও ২ মাস পূর্বে গ্রেপ্তার আসামিরা ভাড়া হিসেবে নিয়েছিল।  

তিনি বলেন, গ্রেপ্তাররা জানান, প্রবাসী যাত্রীদের মাধ্যমে কৌশলে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান পণ্য সামগ্রী গুলিস্তান ও পল্টনসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়। বিদেশ থেকে নিয়ে আসা একটি লাগেজের পণ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন মার্কেটে ১৫-২০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানান তারা। পরে বিক্রয়কৃত মালামালের লভ্যাংশের একটি অংশ গ্রেপ্তার আসামি খোরশেদ নিজে নেন। আর কিছু অংশ যারা বিভিন্ন দায়িত্বে থাকেন তাদেরকে ভাগ করে দেওয়া হয়।  

কে এই খোরশেদ
খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার খোরশেদ ২০০৯ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যান। এক বছর পর দেশে ফেরত এসে বাংলাদেশ অংশে এই চক্রের মূলহোতা হিসেবে কাজ করতেন। প্রবাসী ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ, প্রবাসী ব্যক্তির বিদেশ থেকে দেশে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করা, কৌশলে অপহরণ করানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে থাকা চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন খোরশেদ।  

গ্রেপ্তার জুয়েল অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা কসমেটিক্সের ব্যবসা করতেন। ইতোপূর্বে তার গাজীপুরে সাইকেল ও রিকশা পার্টসের ব্যবসা ছিল তার। প্রবাসী ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনকে অপহরণ এবং বিদেশ থেকে নিয়ে আসা পণ্য রাখার জন্য বাসা খোঁজ করা ও বাসা ভাড়া নেওয়ার কাজ করতেন তিনি। এছাড়াও অবৈধভাবে আনা মালামাল বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানো ও বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে বের করার কাজও করতেন জুয়েল।  

তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিমানবন্দর থানা ও ওয়ারি থানায় একই অপরাধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।

অপরদিকে, গ্রেপ্তার মাসুম আসামি জুয়েলের কসমেটিক্সের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। আগে মাসুম ঢাকায় প্রাইভেট কার চালানোর পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন বলেও জানা যায়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদক সংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে বলেও জানা গেছে।  

গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০২৩
এসজেএ/এসআইএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।