ঢাকা: মুন্সিগঞ্জে পদ্মার শাখা নদীতে গত ১৬ ডিসেম্বর বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় অন্তত ৪০ যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার ডুবে যায়। এতে বেশ কয়েজনের প্রাণহানি ঘটে।
এমন তথ্য সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বরাত দিয়ে জাতীয় কমিটি বলছে, নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৫ হাজার হলেও সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের অন্তত ৮৫ হাজার নৌযান রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৭০ হাজার নৌযানই নিবন্ধনহীন। অবৈধ এসব নৌযানের মধ্যে অন্তত ছয় হাজার রয়েছে বাল্কহেড। অন্যদিকে নিবন্ধিত ১৫ হাজার নৌযানের মধ্যে নিয়মিত বার্ষিক সার্ভে (ফিটনেস পরীক্ষা) করা হয় মাত্র আট হাজারের। নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে অবশিষ্ট সাত হাজার ত্রুটিপূর্ণ নৌযান অবাধে চলাচল করছে। কর্তৃপক্ষ সেগুলোর বিরুদ্ধে অদৃশ্য কারণে ব্যবস্থা না নেওয়ায় অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে।
অবৈধ ও আইন অমান্যকারী নৌযান চলাচলের সুযোগ দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও নৌযান মালিককে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে জাতীয় কমিটি বলছে, এসব নৌযান চলছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে। এসব সংস্থার প্রভাবশালীদের নিয়ে ঘটিত হয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
বিপজ্জনক এসব বাল্কহেডকে নিয়ন্ত্রণে নানান মহল থেকে চাপ এলে রাতে বাল্কহেড না চালানোর নির্দেশ দেয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এতেও বন্ধ নেই দুর্ঘটনা। নৌখাতের মালিক ও শ্রমিক নেতারা বাল্কহেডের বেপরোয়া গতিসহ অদক্ষ চালক দিয়ে বাল্কহেড পরিচালনার নানান অভিযোগ করলেও বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি একেবারেই আমলে নিচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের। তাদের ভাষ্য, এসব দুর্ঘটনার দুয়েকটি তদন্ত কমিটি হলেও অধিকাংশের যথাযথ বিচার হয়নি।
এদিকে লঞ্চ মালিক-শ্রমিকদের অভিযোগ, নদীপথে চলাচল করা অবৈধ নৌযানগুলো দুর্ঘটনায় পড়লে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে আছে একটি সাধারণ আখ্যা দিয়ে। আর সেটি হচ্ছে ‘যান চলাচলে ছিল না অনুমোদন’।
লঞ্চ মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, এসব অবৈধ মালিকরা আইনের মধ্যে থেকেই আইনের একটি বড় সুবিধা নিয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের যোগসাজশে। যখনই এসব অবৈধ নৌযান দুর্ঘটনা ঘটায় তখন মেরিন কোর্টে একটি মামলা করে নৌ-নিট্রা কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের উস্কানি দিয়ে মালিকপক্ষই আরেকটি মামলা করে ফৌজদারি কোর্টে। একইসঙ্গে দুই আদালতে মামলা চলমান থাকায় রায় প্রকাশে বিলম্ব হয় আদালতের। এদিকে লম্বা সময় চলে যাওয়ায় একসময় বাদীপক্ষ ক্লান্ত হয়ে আর খবর নেয় না এসব মামলার।
নৌপরিবহন দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, বালুবাহী নৌযানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাবাতি থাকে না। বালু পরিপূর্ণ অবস্থায় এসব নৌযানের শুধু সামনের কিছু অংশ ও পেছনের অংশ পানির ওপরে থাকে। তাই বাল্কহেডের সঙ্গে যাত্রীবাহী নৌযানের ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটে প্রায়ই।
লঞ্চমালিক সমিতির মহাসচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে। বাল্কহেড চলাচল মনিটর করার দায়িত্ব যাদের, তাদের ম্যানেজ করেই রাতে অবৈধভাবে চলছে বাল্কহেড। রাতে যাত্রীবাহী নৌযান আমরা খুব কষ্টে চালাই। কারণ নদীতে বাল্কহেড এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রের নাম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, যাত্রীবাহী নৌযানে দুর্ঘটনা ঘটেছে শুধু বাল্কহেডের কারণে। ’
সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এই বিপুলসংখ্যক অবৈধ নৌযান বন্ধ করার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম এবং নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা দরকার। প্রয়োজনে এক টানা মাসজুড়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা অভিযান চালাতে হবে। ’
এজন্য সারা দেশে অবিলম্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দাবি জানিয়ে আসছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটিও।
চলতি বছরের ৭ আগস্ট সংবাদমাধ্যমে সংগঠনের সভাপতি হাজি মোহাম্মদ শহীদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দের পাঠানো এক বিবৃতিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ নৌপরিবহন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডের প্রতি এ দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে সনদবিহীন চালককে (মাস্টার ও ড্রাইভার) শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি অবৈধ চালক নিয়োগ দেওয়ায় নৌযান মালিককেও আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির মহাসচিব আশীষ কুমার দে বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাল্কহেড এখন অনেক নৌপথের মরণফাঁদ। নৌ মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এই নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। তা সত্ত্বেও প্রশাসনের নাকের ডগায় এগুলো চলছে। ’
তিনি বলেন, ‘হাজার পাঁচেক বাল্কহেডের নিবন্ধন থাকলেও চলাচল করে ১০ হাজারের বেশি। এছাড়া নিবন্ধিত সব বাল্কহেডের বার্ষিক ফিটনেস নেই। ’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বাংলানিউজকে বলেন, ‘রাতে বালুবাহী নৌযান চলাচল না করার নির্দেশনা আছে। নৌপথে নিরাপত্তার জন্য নৌ-পুলিশ এবং কোস্টগার্ড কাজ করে কিন্তু আমাদের নিজস্ব জনবল নেই । এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে পদক্ষেপ নিতে হবে । ’
বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকেও অবৈধ নৌযান ‘ম্যানেজ’ করে চলে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো প্রমাণ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০২২ সালে ৩৬টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আছে যাত্রীবাহী নৌযান ১০টি, মালবাহী নৌযান ১৭টি এবং অন্যান্য নৌযান ছিল ৯টি।
তবে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে সারা দেশে ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৩১৯ জন, আহত হয়েছেন ৭৩ জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ৯২ জন। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৯টি। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন, আহত হয়েছেন ৭ জন এবং এখনো নিখোঁজ আছেন ১২ জন। সে হিসাবে বিগত দেড় বছরে ২৪৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৭৭ জন নিহত হয়েছেন। এতে ৮০ জন আহত এবং ১০৪ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, বিআইডব্লিউটিএ, নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ এবং নৌযান মালিকদের অবহেলার কারণে নৌপথ নিরাপদ হয়নি। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই দায়ী।
বাল্কহেডের ধাক্কায় ভেঙে গেছে সেতুও
গত ২ অক্টোবর রাতে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার কালাডুমুর নদে বাল্কহেড দুর্ঘটনায় ১৫ বছরের পুরোনো এক সেতু ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনার পর বাল্কহেডের চালক ও তার সহকারীরা সাঁতরে তীরে উঠে যাওয়ায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে সেতুটির ভাঙা অংশ বাল্কহেডের ওপরে পড়লে সেটির কিছু অংশ নদীতে ডুবে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২৩
এনবি/এইচএ/