নরসিংদী: আমি আমার ছেলের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারিনি, এর আগেই সে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়া সময় বলে গেছে, ভার্সিটির হলে আর থাকবে না।
এমনইভাবে আক্ষেপ করতে করতে বুকফাটা কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বাসের ধাক্কায় নিহত হওয়া চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শান্ত সাহার (২২) বাবা কাজল সাহা।
এ সময় শান্তর বাবার হৃদয়বিদারক কান্নায় নরসিংদী পৌর শহরের সেবাসংঘ মন্দিরের আশপাশ এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠে। এসময় স্বজন ও এলাকাবাসী মেধাবী এই শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়ায় বাস-মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চুয়েট শিক্ষার্থী শান্ত সাহার মরদেহ সকালে নরসিংদীতে এসে পৌঁছে। এ সময় তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এদিকে মেধাবী ছাত্র শান্তর মরদেহ নরসিংদী এসে পৌঁছলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন কমিউনিটি নেতাসহ রাজনৈতিক নেতারা এসে ভিড় জমায়।
নিহত শান্ত সাহা সেবা সংঘ এলাকার বাসিন্দা কাজল সাহা ও শিউলি রাণী সাহা দম্পতির ছোটা ছেলে। এই দম্পতির ৩ ছেলের মধ্যে শান্ত সাহা সবার ছোট। শান্ত সাহার বড় ভাই কৌশিক সাহা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক সিলেটের কোলাউড়া শাখায় কর্মরত আছেন। মেজো ভাই পার্থ সাহা ভারতের হরিয়ানায় কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ছেন। আর সবার ছোট শান্ত সাহা চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের ২০তম ব্যাচের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
সেবাসংঘ দূর্গাবাড়ি মন্দিরের পাশেই নিহত শান্ত সাহাদের বাড়িতে মা শিউলি রাণী সাহা বুক ও কপাল চাপরাচ্ছে আর আহাজারি করছেন। তিনি বিলাপ করছেন আর কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছে। ‘আমার ইঞ্জিনিয়ার পোলা কই গেলো গো’ বলে বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা চোখে মুখেসহ মাথায় পানি দিয়ে কিছুটা সুস্থ করছেন। মূর্ছা থেকে জ্ঞান ফিরে আবারও একইভাবে আহাজারি করে বলছেন, ‘আমার সোনার চাক্কা আর নাই, আমিও আর বাঁচতে চাই না। পোলা ইঞ্জিনিয়ার হইয়া বিদেশে যাইব। আমারে কইছিল, ‘মাগো, তোমারে বিদেশে নিয়া গিয়া চিকিৎসা করামু। ’ আমার ইঞ্জিনিয়ার পুতে গেল কই? আমারে কে বিদেশ নিয়া যাইব? আমার পোলারে আইন্যা দেও তোমরা। ’ এ সময় স্বজন ও প্রতিবেশীরা শিউলি রাণী সাহাকে সান্ত্বনা দেন।
এর আগে সোমবার শান্ত সাহা তার একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জুনিয়র শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে রাঙ্গুনিয়া থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে কাপ্তাই সড়কের সেলিনা কাদের চৌধুরী কলেজ সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছলে শাহ আমানত নামের দ্রুতগামী একটি বাস মোটরসাইকেলটিকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেলের আরোহী শিক্ষার্থীরা ছিটকে পড়েন। ঘটনাস্থলেই শান্তর মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত হন অপর দুজন। পরে আহত অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার করে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তৌফিককে মৃত ঘোষণা করেন। আহত হিমু হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার পা ভেঙে গেছে। বর্তমানে সে আশঙ্কামুক্ত চিকিৎসক জানিয়েছেন।
নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দীপক সাহা বলেন, শান্ত একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। আর এক বছর পরেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে পাশ করে বের হতো। আমাদের পাড়ার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে এটা আমাদের জন্যও গর্বের বিষয় ছিল। শান্তর বাবা-মা ও আমাদের এলাকাবাসীর সে স্বপ্ন পূরণ হলো না। এর আগেই অকালে প্রাণ হারাতে হলো তাকে। তার এই অকাল মৃত্যুতে আমি ছেলে হারা মা-বাবাকে কি সান্ত্বনা দিবো সেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
নরসিংদী জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি ও শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার অনিল ঘোষ বলেন, শান্ত সাহার মতো একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুর বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তার মা-বাবাকে কি বলে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২৪
এসএম