ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘পুলিশ হুনলে ছেলের লাশও পাইবেন না, উল্টা আপনাগো ধইরা নিয়া যাইব’

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০২৪
‘পুলিশ হুনলে ছেলের লাশও পাইবেন না, উল্টা আপনাগো ধইরা নিয়া যাইব’ কোটা আন্দোলনে নিহত ছেলের কবরের পাশে অঝোরে কাঁদছেন মা। ইনসেটে নিহত সায়েম হোসেন আলিফ। ছবি: ডিএইচ বাদল

ঢাকা: ‘পুলিশের গুলি খাইছে। পুলিশ যদি হুনে, তাহলে আপনের ছেলের লাশও পাইবেন না, আপনার ছেলেরে মাটিও দিতে পারবেন না।

উল্টা আরো আপনাগো ধইরা নিয়া যাইবো। আপনি তাড়াতাড়ি ছেলেরে নিইয়্যা যান। নিয়া তাড়াতাড়ি মাটি দ্যান। ’

গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতলের বারান্দায় পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ মৃত ছেলেকে বাঁচাতে যখন চিৎকার করে ডাক্তারদের ডাকছিলেন তখন মা শিউলি আক্তারকে এভাবেই ছেলের লাশ নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন হাসপাতালের চিকিৎসক ও আশপাশের সাধারণ মানুষ।  

অসহায় এই মা ময়নাতদন্ত, মৃত্যুসনদ ছাড়াই রিকশা করে ছেলের লাশ নিয়ে আসেন রাজধানীর জুরাইনের একটি হাসপাতালে। সেখানেও কোনো সহায়তা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে যান বাবার বাড়ি কেরানীগঞ্জে। পরে স্থানীয় একটি কবরস্থানে মাঝরাতে তড়িঘড়ি করে কবর দেন বুকের ধনকে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ির কাজলা এলাকার টোল প্লাজায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন ২১ বছর বয়সী মো. সায়েম হোসেন আলিফ। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে প্রথমে স্থানীয় দেশবাংলা হাসপাতালে নিয়ে যান বন্ধুরা। পরে সেখান থেকে ঢামেক নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

জানা গেছে, সায়েম বাবা-মায়ের সঙ্গে জুরাইনের মুরাদপুর এলাকার কুদার বাজারে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। বাবা কবির হোসেন টিটু পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী। মা শিউলি আক্তার গৃহিণী। তিনি বছর বয়সী একটি ছোট ভাই আছে তার। কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে তাদের নিজেদের বাড়ি রয়েছে। ২০২০-২১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর আর পড়ালেখা করেনি সায়েম। এরপর থেকে কাজ শিখছিল ধলাইপাড়ের একটি ওয়ার্কশপে।

কোটা আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহত সায়েম হোসেন আলিফ।  ছবি: ডিএইচ বাদল

সায়েম ওয়ার্কশপে কাজ করার কারণে কোটা আন্দোলনে যায়নি কখনো। শুক্রবার বন্ধের দিন থাকায় বন্ধুদের ফোন পেয়ে হাসনাবাদের বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর আর ওই বাড়িতে ফিরতে পারেনি সে। ফিরতে পারেনি জুরাইনের ভাড়া বাসায়ও। মৃত্যুর পর পুলিশের ভয়ে তাকে কবর দেওয়া হয় নানার বাড়ি কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে একটি স্থানীয় কবরস্থানে।

সম্প্রতি সায়েমের নানাবাড়ি কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে গিয়ে কথা হয় তার মা শিউলি আক্তারের সঙ্গে। ছেলের হত্যার জন্য পুলিশ ও তাদের নির্দেশদাতাদের দায়ী করেন তিনি।  

ঢামেকে ছেলের লাশ আনার বর্ণনা দিয়ে শিউলি আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ১৯ জুলাই এশার নামাজের পর সায়েমের বন্ধুরা আমাকে ফোন দিয়ে হাসাপাতালে যেতে বলে। আমি আর সায়েমের আব্বু হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ছেলে বারান্দায় পইড়্যা রইছে রক্ত মাখা। সব রক্তে ভাইস্যা গেছে গা। এত রক্ত। চারপাশে ওর বন্ধুরা দাঁড়ায় রইছে। ওই (সায়েম) শুয়ে আছে বারান্দায়। আমি তাদের জিগাইছি, আমার পোলার কি হইছে? কই লইয়্যা গেছিলি? কোন জায়গার থেকে এমন হইছে?  একটা ছেলেও কিছু বলে না। পরে আমি আমার ছেলেরে ধইরা কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করছি, পরে দেখি ছেলেরা আর নাই।

নিহত সায়েমের রক্তাক্ত ছবি নিয়ে মা শিউলির আহাজারি।  ছবি: ডিএইচ বাদল

তিনি আরো বলেন, আমি ডাকতাছি, ডাক্তার আইয়েন, দেখেন আমার ছেলেরে। সবাইরে ডাকছি, একটু অক্সিজেন লাগায় দেন। আমার ছেলেটা কি আছেনি? আমার ছেলেটা যে বারান্দায় পইড়্যা রইছে, আপনারা দেখেন না কেন? দেখেন একটু আছেনি? তারা কয়, না, আপনার ছেলে আর নাই। ওরে দেখেলে আর কোনো কাজ হইবো না। আপনি নিয়ে যান। যত তাড়াতাড়ি পারেন নিয়ে যান। আমি কই, ডাক্তার ডাকেন, বড় ডাক্তার। একটু অক্সিজেন লাগান। কয়, না আর কোনো কাজ হইবো না। তাড়াতাড়ি নিইয়্যা যান। যদি না নিয়ে যান, পুলিশের গুলি খাইছে। পুলিশ যদি হুনে, তাহলে আপনের ছেলের লাশও পাইবেন না, আপনার ছেলেরে মাটিও দিতে পারবেন না। উল্টা আরো আপনা গো ধইরা নিয়া যাইবো। আপনি তাড়াতাড়ি ছেলেরে নিইয়্যা যান। নিয়া তাড়াতাড়ি মাটি দ্যান।

কথা বলার সময় বার বার ছেলের শোকে কেঁদে উঠছিলেন শিউলি আক্তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ওই সময় আমরা হাসনাবাদের বাড়িতে ছিলাম। বুধবার (১৭ জুলাই) ও বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সায়েম ওয়ার্কশপের কাজ শেষ করে দুপুরে বাসায় চলে আসতো। বাসা থেকে ওই দুইদিন বের হয়নি। শুক্রবার (১৯ জুলাই) সারাদিন বাসায় ছিল। দুপুরে গোসল করে জুমার নামাজ পড়ছে। নামাজ পড়ে বাসায় আসছে। আমার সাথে খাওয়া দাওয়া করছে। আমি বিরিয়ানি রান্না করছিলাম। এই শেষ খাওয়া আমার ছেলে আমার সাথে খাইছে।

তিনি আরও বলেন, খাওয়া শেষে সায়েম মোবাইল নিয়ে বসছে। মোবাইলে নেট বন্ধ। তখন ও বলে, আম্মু নেট নাই, টিভিও বন্ধ, কিছুই দেখতে পারি না। বলে, তার ভালো লাগছে না। তখন আমি বলছি, ভালো না লাগলে শুয়ে থাক। কোথাও যাইস না। পরে শুয়ে ছিল। এর কিছুক্ষণ পরে তার বন্ধুরা ফোন দেয় জুরাইন থেকে। পরে আমারে না বলেই চলে যায় সায়েম। ৪টায় আসরের নামাজের পর। আমি উঠে দেখি সায়েম ঘরে নাই। পরে আমি আসরের নামাজ পড়ে সায়েমরে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, সায়েম তুই কই? বলে, আমি কুদার বাজার (যাত্রাবাড়ী)। কইলাম, তুই কুদার বাজার কিয়ের লাইগ্যা গেছত? কয়, আব্বুর কাছে গেছি, কথা বইলা আইয়্যা পড়ুম। আমি কইছি, তুই ওইদিকে গেলি ক্যান? গ্যাঞ্জাম হইতাছে, ঝামেলা হইতেছে, তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। তুই আমার একটা কথাও শুনছ না। সায়েম কয়, তুমি ফোন রাখো আইতাছি। ওর সাথে এই আমার শেষ কথা। আর আমার সাথে কোনো কথা হয় নাই। এরপর আর আমি ফোন দেই নাই। ভাবছি আইতেছে। আমি ওইটা ভাইবা মাগরিবের আজান দিছে আর আমি নামাজ পড়ছি। নামাজ পইড়্যাও সময় গেছে, আমি আর ফোন দেই নাই, সেও আর আমারে ফোন দেয় নাই। তারপর এশার নামাজের একটু পড়ে তার এক বন্ধু আমারে ফোন দিয়ে জিগায়, আপনি কি সায়েমের আম্মু? আমি কই- হ। কয়, সায়েম তো গুলি খাইছে, আপনি তাড়াতাড়ি আসেন। আমি কই, হায় হায় কি কয়, কোন জায়গায় কেমনে গুলি খাইলো? পরে কয়, আপনি আসেন, সায়েম গুলি খাইছে। আমি কই, কে গুলি করছে। কয়, পুলিশের গুলি খাইছে। আপনি হাসপাতালে আসেন।

বড় ভাইয়ের ছবি হাতে সায়েমের ছোটভাই।  ছবি: ডিএইচ বাদল

হাসপাতালে কারো সাহায্য পাননি জানিয়ে নিহত সায়েমের মা আরো বলেন, আমি তো এক নিরীহ মা। তখন তো ভয়ানক পরিস্থিতি ছিল। কার্ফু (কারফিউ) দিয়া দিছে। আর কোনো গাড়ি ঘোড়া চলে চলে না। আবার এটাও নাকি বলে, যারে রাস্তায় পাইবো, গুলি করবো। আমি যে আমার ছেলেরে আনমু, আমি একটা অ্যাম্বুলেন্সও পাই নাই। আমি এদিকে দৌড়াই, ওদিকে দৌড়াই, একটা অসহায় মা। কাউরে পাশে পাই নাই। এত যে ডাকাডাকি, করলাম, কেউরে পাশে পাই নাই। পরে আমি একটি রিকশা আইন্যা জুরাইন আদ্বদীন হাসপাতালে আনছি। এই জায়গায়ও কোনো ডাক্তার আহে না। কেউ দেখে না। পরে ওইখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নানীর বাড়িতে নিইয়্যা আইছি। পুলিশের লাশ গুম করে ফেলার ভয়ে লাশ জুরাইন নিতে পারি নাই। এইখানে আইন্যা রাত ২টা বাজে সবাই মিইল্যা রসুলপুর কবরস্থানে মাটি দিছি।

শুক্রবার ছেলের জীবন কেড়ে নিছে জানিয়ে শিউলি আক্তার বলেন, শুক্রবার বন্ধ ছিল, আর এই শুক্রবারই আমার ছেলে জীবন কাইড়্যা নিছে। আমার বুকের একপাশ খালি হয়ে গেছে। এখন আমি কি নিয়ে বাঁচমু?

ছেলের মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত ও মৃত্যুসনদ পাননি হতভাগ্য এই মা। তবে এখন ছেলের মৃত্যুর বিচার চান তিনি। পাশাপাশি সায়েম যাতে শহীদি মর্যাদা পায় সেই দাবিও জানান তিনি।  

শিউলি বলেন, আমার ছেলে যে দেশের জন্য রক্ত দিল, আমার ছেলে যে দেশের জন্য শহীদ হইলো, কেউ তো জানলো না। আমি কাউরে জানাইতে পারলাম না, বলতে পারলাম না। তাহলে সবাই শহীদের মর্যাদা পাইতাছে, আমার ছেলের এটা ধামাচাপা যাবে কেন? এজন্য আমি অনেক জায়গায় গেছি।

তিনি আরো বলেন, আমার ছেলের মতো মৃত্যু যেন আর কারো না হয়। আমার ছেলেরে যারা হত্যা করছে, যারা ওপর থেকে নির্দেশ দিছে, তাদের সবার বিচার যেন হয়। আমার ছেলে যেন শহীদি মর্যাদা পায়। আমার ছেলে অনেক নিরীহ ছিল। যারা তারে নির্মমভাবে হত্যা করছে, তাদের বিচার চাই।

গত বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) ছেলের হত্যার জন্য ডেমরা থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন শিউলি আক্তার। তবে থানা থেকে কোনো মামলা নেওয়া হয়নি। বরং, আদালতে গিয়ে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছে থানা কর্তৃপক্ষ। আগামী রোববার (২৫ আগস্ট) আদালতে মামলা করতে যাবেন বলে জানান শিউলি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০২৪
এসসি/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।