ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

যমুনার ভাঙন

‘নদীর যে কাছারে ঘর তুলি হেই কাছারই ভাঙে’

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪
‘নদীর যে কাছারে ঘর তুলি হেই কাছারই ভাঙে’

সিরাজগঞ্জ: ‘আমরা নদীর কাছারে (পাড়) থাহি, যে কাছারে ঘর তুলি হেই কাছারই ভাঙে। আমরা কোনে (কোথায়) কোনে থাকি তার ঠিক নাই।

আমরা কিছুই চাই না খালি আমাগোরে নদীর পাড়গুলো যেন বাইন্ধ্যা দেয়। এক জায়গায় কুইড়্যা তুইল্যা যেন থাইকপার পারি। ’

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাঁট পাচিল গ্রামের যমুনার ভাঙনে দিশেহারা বিধবা নারী রহিমা খাতুন কথাগুলো বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর ধইর‌্যা নদীর বাঁধের কাম আইছে, কামের কাম কিছুই করে না, খালি আমাগোরে ক্ষেত-খোলার মধ্যে বুলাক বানাইয়া অন্য জায়গায় নেয়। ’ 

সম্প্রতি সরেজমিনে যমুনার ভাঙনকবলিত হাঁট পাচিল এলাকায় গেলে রহিমার মতো এমন ক্ষোভের কথা বলেন অনেকেই। ফজিলা খাতুন নামে এক নারী বলেন, আগে হাঁট পাচিল গ্রামে আমাদের বাড়ি ছিল। চার বছর আগে সেটা ভেঙে যায়। এরপর বাঁধের ওপর আশ্রয় নেই। পরে আমার স্বামীর চড়ার জমিতে মাটি ফেলে বাড়ি করি। সেই বাড়িটিও নদীগর্ভে যাওয়ার পথে।  

ময়নাল সরদার নামে এক বৃদ্ধ কৃষক বলেন, আমার নয় বিঘা জমি ছিল। কয়েক বছরে যমুনার ভাঙনে সব বিলীন অইয়্যা গেছে। বাড়িডাও গিলতে শুরু করেছে রাক্ষসী যমুনা। কয়েকদিন ধইর‌্যা ভাঙনে বাড়ির সিকি অংশ বিলীন অইয়া গেছে। তিনি বলেন, পালের গরু বাছুর বেইচা খাইয়্যা শ্যাষ করছি, এহন আমি নিঃস্ব, ভাত পাওয়াই কঠিন। বাড়িটা চইলা গেলে মাইনসের দ্বারে যাইয়া থাকা লাইগবো।  

কথা হয়, গৃহিণী বেলি খাতুন, শাহিদা খাতুন, বুলবুলি খাতুনসহ অনেকের সঙ্গে। তারা জানান, যমুনার ভাঙনে নিজেদের নিঃস্ব হওয়ার গল্প। গল্পগুলো স্বপ্নের মতো মনে হলেও এখানকার বাস্তবতা এটাই। মাসখানে আগে কোবাদ মাস্টার নামে মধ্যবিত্ত কৃষকের দোতলা ভবন তার চোখের সামনেই নদীতে বিলীন হয়েছে। নদীগর্ভে চলে গেছে তার বিশাল গরুর খামারটিও।

জানা যায়, বর্ষা মৌসুম শেষ হয়েছে অনেক আগেই। একমাসেরও বেশি সময় ধরে কমছে যমুনার পানি। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পশ্চিম তীরে ভাঙন চলছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কখনও মৃদু কখনও বা তীব্র ভাঙনে একের পর এক বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। ভাঙন হুমকিতে রয়েছে কবরস্থান, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা।  

হাট পাঁচিলের পাশাপাশি একই উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর, পাকড়তলাতেও একইভাবে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গত একমাসে ধারাবাহিক ভাঙনে ৭০০ বেশি বসতবাড়ি, কয়েকশো বিঘা কৃষিজমি, রাস্তাঘাট ও ব্যক্তিগত স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় শত শত পরিবার এখন ভূমিহীন।

এদিকে ২০২২ সালে শুরু হওয়া পাউবোর নদী তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণকাজে গাফিলতির কারণে এ অঞ্চলটি ভাঙনের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে না বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।  

কথা হয় চায়না মণ্ডল, আজমত শেখ, ওসমান শেখ, রহিমা খাতুন, সানজিদা, বকুল, রুমানাসহ স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। বাংলানিউজকে তারা বলেন, সিরাজগঞ্জ পাউবোর ঠিকাদাররা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করতেন তাহলে বর্ষায় আমাদের পাঁচ শতাধিক ঘর নদীতে বিলীন হতো না।  

নদী তীরবর্তী মানুষদের দাবি, আমরা কোনো সাহায্য চাইনা, তাড়াতাড়ি আমাদের বাঁধ নির্মাণ করে আমাদের বাড়িঘরগুলো ভাঙন থেকে রক্ষা করা হোক।  

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেসুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ওই এলাকায় নদী তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। যমুনায় পানির স্রোত বেশি থাকায় এখন কাজ বন্ধ। এক মাসের মধ্যে কাজ শুরু হবে। ভাঙনরোধে আমরা আপাতত সেখানে কিছু জিওব্যাগ ডাম্পিং করেছি। এখন ভাঙনের তীব্রতা কিছুটা কমে এসেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর  ১৫, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।