ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সোনারাঙা ধান ঘরে তোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন কৃষকরা

মো. মামুনুর রশীদ, ডিষ্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০২৪
সোনারাঙা ধান ঘরে তোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন কৃষকরা

নাটোর: দুই লাখ ৬১ হাজার ৬৬৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নাটোর জেলায় এ বছর উফশী, হাইব্রিড ও স্থানীয় জাতের বীজে ৭৬ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধান চাষাবাদ হয়েছে। আর এ ফসল চাষাবাদে উৎসাহ প্রদানসহ কৃষির উৎপাদন বাড়াতে ১০ হাজার ৬০০ জন কৃষককে প্রণোদনা বাবদ বিনামূল্যে বীজ ও সার দিয়েছে সরকার।

আগামী নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হবে। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে এবারো রোপা-আমনে বাম্পার ফলনের আশায় রয়েছেন এ জেলার কৃষক।
 
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দেখা যায়, মাঠে মাঠে সোনালী রঙ ধারণ করেছে রোপা আমন ধান। কোথাও ধানের দানা পরিপক্কতা পেয়েছে, আবার কোথাও আধা-পাকা দানা নিয়ে জমিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ধান গাছ। কাটা-মাড়াই শুরু করতে আরো বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। তবে চাষিরাও বসে নেই। তাদের কাঙ্ক্ষিত ধান কাটার পর ওই জমিতে ভুট্টা,আগাম জাতের আলু, ফুলকপি, বাধাকপিসহ শীতকালীন সবজি চাষাবাদের জন্য চারা বা বীজ সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন। এখন সোনারাঙা সেই ধান ঘরে তোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন কৃষকরা।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্র জানায়, চলতি খরিপ-২ মৌসুমে জেলায় রোপা আমন ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭৫ হাজার ১০০ হেক্টর। এরমধ্যে উফশী জাত ৬৯ হাজার ২৫০ হেক্টর, হাইব্রিড ৫ হাজার ৪০০ হেক্টর ও স্থানীয় জাত ৪৫০ হেক্টর। সেখানে চাষাবাদ হয়েছে ৭৬ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে উফশী জাত ৭০ হাজার ৩৫ হেক্টর, হাইব্রিড ৬ হাজার ১৯০ হেক্টর ও স্থানীয় জাত ৬৫০ হেক্টর।

অপরদিকে এ বছর ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৬৫ মেট্রিক টন। গত মৌসুমে রোপা আমন ধান উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৬০ হাজার ৩৯২ মেট্রিক টন। যার বিঘা প্রতি ফলন ছিল ১৭ মন এবং প্রতি হেক্টরে গড় ফলন ছিল ৩ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন। গত জুলাই মাসের প্রথম থেকে চারা রোপণ শুরু হয়, আগামী নভেম্বর মাসের প্রথম থেকে ধান কাটা মাড়াই শুরু হবে। এবারো লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বেশি পরিমাণ ধান উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ।

সূত্র জানায়, এবার সদর উপজেলায় চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৮৯০ হেক্টর, সেখানে অর্জিত হয়েছে ১১ হাজার ২৫ হেক্টর। নলডাঙ্গায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৮৯০ হেক্টর, সেখানে অর্জিত হয়েছে ৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর।  

সিংড়া উপজেলায় চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ হাজার ১৪০ হেক্টর, সেখানে অর্জিত হয়েছে ২৩ হাজার ১১০ হেক্টর।  

গুরুদাসপুর উপজেলায় চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৫১০ হেক্টর, সেখানে অর্জিত হয়েছে৬ হাজার ৬১০ হেক্টর।  

বড়াইগ্রাম উপজেলায় চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ২৪০ হেক্টর, সেখানে অর্জিত হয়েছে ১৬ হাজার ২৬০ হেক্টর।  

লালপুর উপজেলায় চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ হাজার ৬৭০ হেক্টর, সেখানে অর্জিত হয়েছে ৯ হাজার ১৪০ হেক্টর এবং বাগাতিপাড়া উপজেলায় চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৭৭০ হেক্টর, সেখানে অর্জিত হয়েছে ৬ হাজার ২৯০ হেক্টর।

চলতি খরিপ-২ মৌসুমে জেলায় রোপা আমন ধান চাষাবাদে আগ্রহী করাসহ ধান উৎপাদনে উৎসায়ী করতে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ১০ হাজার ৬০০ জন কৃষককে কৃষি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৮ হাজার ৬০০ জনকে রোপা আমন প্রণোদনা এবং ২ হাজার জনকে রেমালের ক্ষতি বাবদ পুর্নবাসন কর্মসূচির আওতায় প্রণোদনা দেওয়া হয়। আর প্রণোদনা বাবদ প্রত্যেক কৃষককে ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি করে ডিএপি ও এমওপি সার দেওয়া হয়।

প্রথম পর্যায়ে সদর উপজেলায় ১ হাজার ৩৫০জন, সিংড়ায় ২ হাজার ২০০ জন, গুরুদাসপুর উপজেলায় ৯৫০ জন, বড়াইগ্রাম ১ হাজার ৩৫০ জন, লালপুর উপজেলায় ১ হাজার ২০০ জন, বাগাতিপাড়ায় ৭৫০ জন ও নলডাঙ্গায় ৮০০ জন কৃষককে এসব প্রণোদনা দেওয়া হয়।  

দ্বিতীয় পর্যায়ে সদর উপজেলায় ২৫০ জন, সিংড়ায় ৪৫০ জন, গুরুদাসপুর উপজেলায় ২১০ জন, বড়াইগ্রাম ২৫০ জন, লালপুর উপজেলায় ২৮০ জন, বাগাতিপাড়ায় ২৮০ জন ও নলডাঙ্গায় ২৮০ জন কৃষককে এসব প্রণোদনা দেওয়া হয়। এতে বরাদ্দ পাওয়া যায় প্রথম পর্যায়ে ৬০ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ পাওয়া যায় ১৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা।

স্থানীয় বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা জানান, এ বছর সার, বীজ ও বালাইনাশক সংকট তেমন ছিল না বললেই চলে। বিদ্যুতের সমস্যা হলেও বৃষ্টি হওয়ায় সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন তারা। ফলে ফসলের মাঠ অনেক সুন্দর হয়েছে। পাশাপাশি ধানের সবল-সতেজ চারা পাওয়ায় এবার ধানের শীষ ভালো হয়েছে, দানাও ভালো হয়েছে। তাই এবার ধানের বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে চলতি এ মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা।

নলডাঙ্গা উপজেলার ঠাকুর লক্ষিকোল গ্রামের কৃষক রেজাউল করিম জানান, এবার তিনি ৪ বিঘা জমিতে আমনের আবাদ করেছেন। ফসলের অবস্থা বেশ ভালো, আশা করা যাচ্ছে ভালো ফলন হবে। গত বছর বিঘা প্রতি ১৬ থেকে ১৭ মন হারে ফলন হয়েছিল।  

হলুদঘর গ্রামের কৃষক আজাহার আলী, লুৎফর রহমানসহ আরো অনেকে জানান, বোরো ধান করার পর আবার ওই জমিতে রোপা আমন ধান চাষাবাদ করতে পেরে তারা প্রতি বছর অধিক লাভবান হচ্ছেন। সুযোগ পেলে তারা চাষের পরিধি বাড়াবেন।

সদর উপজেলার জাঠিয়ান গ্রামের কৃষক জিল্লুর রহমান, বড়ভিটা এলাকার কৃষক হযরত আলী জানান, প্রতি বছর এ সময় ধান চালের দাম একটি বেশি থাকে এবং অনেক কৃষকই অভাবে পড়েন। কাজেই এ সময়ে রোপা আমন ধান ঘরে তুলতে পারলে খাবার চাহিদা মেটানো, অভাব দূর হওয়াসহ আর্থিকভাবে তারা লাভবান হবেন। পাশাপাশি দেশের ধান-চালের বাজারও স্বাভাবিক হবে। বর্তমানে এক মণ ধান ১ হাজার ৫৮০ টাকা থেকে ১ হাজার ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে জানান, দেশের খাদ্যে স্বয়ংসর্ম্পূণ ও উদ্বৃত্ত কয়েকটি জেলার মধ্যে নাটোর জেলা একটি। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল ফসল উপাদনে ও উদ্বৃত্ত কয়েকটি জেলার মধ্যে এ জেলা এগিয়ে রয়েছে। আশা করা যায়, এবারো উৎপাদিত রোপা আমন ধান নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য জেলায় চাহিদা মেটাবে।

তিনি বলেন, গত জুলাই মাসের মধ্যবর্তী সময় থেকে কৃষকরা জমিতে চারা রোপণ করেছেন। অনেকে আগাম হিসেবে এর আগেও চাষাবাদ শুরু করেছেন। কেউ কেউ একটু বিলম্বে চারা রোপণ করেছেন। তাই রোপণের সময়ের ওপরই ধান বা যে কোনো ফসলের বেড়ে উঠা বা কর্তনের সময় নির্ভর করে। তবে এ পর্যন্ত জেলায় রোপা আমন ধান প্রায় ৮০ ভাগ কর্তন উপযোগী হয়েছে। এবার অন্যান্য ফসলের ন্যায় রোপা আমন ধান আবাদ ভালো হয়েছে। মাঠে ধানের অবস্থা সন্তোষজনক। আগামী নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হবে।

উপ-পরিচালক বলেন, বিগত বছরগুলোর মতো চলতি মৌসুমেও রোপা আমন ধানের চাষাবাদের পরিধি ও উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের প্রণোদনা বাবদ বিনামূল্যে উন্নত জাতের বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কৃষি বিভাগ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। ফলে কৃষকের প্রচেষ্টা আর কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা রোপা আমন ফসল চাষাবাদ ভালো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে বিগত বছরের ন্যয় এবার রোপা আমনে বাম্পার ফলন হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর, ২৬, ২০২৪
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।