ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ পৌষ ১৪৩১, ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

কেরানীগঞ্জে সরকারি জমির মাটি চুরির হিড়িক, নির্বিকার প্রশাসন 

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪
কেরানীগঞ্জে সরকারি জমির মাটি চুরির হিড়িক, নির্বিকার প্রশাসন  কেরানীগঞ্জের মঠবাড়ি এলাকায় মাটি কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে চক্রের সদস্যরা। গত বৃহস্পতিবার তোলা। ছবি: সংগৃহীত

কেরানীগঞ্জ: ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ফসলি ও সরকারি জমির মাটি কেটে চুরি করে ইটভাটা, বাড়িঘর ও নির্মীয়মাণ কারখানায় বিক্রি করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। মাটি বহনকারী ট্রলি, ট্রাক ও ডাম্পার চলাচলে ভেঙে যাচ্ছে সড়ক।

মাটি চুরির এই হিড়িক পড়েছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কাজিরগাঁও মঠবাড়ি এলাকায়। এতে নষ্ট হচ্ছে আশপাশের ফসলি জমি, পরিবেশ ও গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক।

মাটিচোর চক্রের সদস্যরা অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসীর পাহারায় প্রতিদিন শ্রমিকের সহায়তায় ভেকু দিয়ে মাটি কেটে ট্রলি, ট্রাক ও ডাম্পার ভরে নিয়ে যাচ্ছে। চোরাই এই মাটি যায় আশপাশের ইটভাটা, নিচু বাড়িঘর এবং নির্মীয়মাণ কলকারখানায়। এর মধ্যে অন্তত ৯৫ শতাংশ মাটি যায় ইটভাটায়। প্রতি ট্রাক মাটি সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।

চোররা প্রতিদিন অন্তত তিন শ ট্রাক মাটি চুরি করে বিক্রি করছে। শিফট করে দিনে ও রাতে ২৪ ঘণ্টা চলে এই মাটি কাটা। কেউ বাধা দিতে গেলে শিকার হতে হয় নির্যাতনের। স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রশ্রয়ে মাটিচোর চক্রের সদস্যরা অবাধে কেটে নিচ্ছে মাটি।

জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর কোলঘেঁষা কোণ্ডা ইউনিয়নে প্রধান সমস্যা মাটি চুরির এই সদস্যরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পার হলে কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ মোড়। সেখান থেকে বাঁ দিকে এগিয়ে কোণ্ডায় প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে, সেখানে আর সমতল ভূমি কিংবা কৃষিজমি নেই। ফসলি জমি, বসতভিটা হয়ে গেছে পুকুর, ডোবা কিংবা বড় আকারের দিঘি।

ব্রাহ্মণগাঁও, নোয়ার্দা ও কান্দাপাড়া, বীর বাঘৈর, কাজিরগাঁও মঠবাড়ি এলাকার বাসিন্দারা জানান, এলাকায় বেশির ভাগ জায়গায় কৃষি আবাদ বন্ধ হয়ে গেছে।

মাটিচোর চক্রের হুমকি-ধমকিতে অনেক মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মাটিচোররা প্রভাবশালী হওয়ায় থানায় অভিযোগ দিতে সাহস পান না ভুক্তভোগীরা। এই পরিস্থিতির মধ্যেও গত তিন বছরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় ২০টির বেশি জিডি করেছেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার। নির্বিচারে মাটি কেটে নেওয়ায় ওই এলাকা বিরানভূমি হয়ে গেছে।

কোন্ডা ইউনিয়নের কাজিরগাঁও মঠবাড়ি এলাকার বাসিন্দারা জানান, কোন্ডা ইউনিয়নের প্রভাবশালী আফজাল সিকদারের নেতৃত্বে মো. শামীম, আবু সাঈদ, মো. হান্নান, রানা সিকদার ও জাবেদ বাহিনী অনেকটা প্রকাশ্যে ফসলি জমি ও সরকারি জমির মাটি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।

এলাকার বাসিন্দারা জানান, এই মাটি কাটার সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের সদস্যরা জড়িত। প্রশাসন বিষয়টি জানলেও নির্বিকার। মাটিচোর চক্র প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ ও প্রশাসন চুপ রয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর শুধু হাতবদল হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অভিযুক্ত আফজাল সিকদারের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কোন্ডা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। আমরা ১২ ভাই। কাজিরগাঁও মঠবাড়ি এলাকায় আমাদের অনেক জমি রয়েছে। আমরা কোনো ভাই এক ইঞ্চি জমিও বিক্রি করিনি। আমরা অন্যের জমি থেকে মাটি কাটব দূরের কথা, নিজের জমির মাটিও কাটি না। যদি মঠবাড়ি এলাকায় আমার কোনো ভেকু বা ট্রাক থাকে তাহলে তাদের আটক করে থানা পুলিশের কাছে দিয়ে দিতে পারেন। ’

এদিকে এলাকাবাসী জানান, কেরানীগঞ্জে জাল দলিলের মাস্টার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কোন্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক দীন ইসলাম বর্তমানে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের সমর্থন নিয়ে একইভাবে আগের মতো জাল দলিল করে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের নেতাদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন অসহায় ও সাধারণ মানুষের জমি অন্যায়ভাবে জাল দলিল করে বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। জাল দলিলের মাধ্যমে মানুষের জমি আত্মসাৎ করা ছিল তার নেশা। জাল দলিল করে তিনি কোটিপতি বনে যান।

বীর বাঘৈরের বাসিন্দা সামসুদ্দিন ও বাবুল মিয়া জানান, তারা ওয়ারিশসূত্রে প্রায় ৪০ শতাংশ জমির মালিক। কিন্তু জাল দলিলের মাস্টার দীন ইসলাম জাল দলিলের মাধ্যমে তাদের জমি প্রভাবশালী এক লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।

জাল দলিলের মাস্টার দীন ইসলাম

বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগম জানান, তার ছেলে-মেয়ে মিলে তাকে ১০ শতাংশ জমি কিনে দিয়েছিলেন। জাল দলিলের মাস্টার দ্বীন ইসলাম তাঁর সেই জমি জাল দলিলের মাধ্যমে অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা আরো জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাল দলিলের মাস্টার দীন ইসলাম কোন্ডা ইউনিয়নে জাল দলিলের একটি চক্র গড়ে তোলেন। চক্রটি প্রতারণা করে জাল দলিলের মাধ্যমে ইউনিয়নের শতাধিক পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে দীন ইসলামের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘জমিসংক্রান্ত কোনো বিষয় আমার দেখভাল করার কথা নয়। এটা দেখবে এসি ল্যান্ড বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। আর এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

কেরানীগঞ্জের ইউএনও রিনাত ফৌজিয়া বলেন, ‘কৃষি ও সরকারি জমির মাটি কেটে বিক্রির বিষয়টি এইমাত্র জেনেছি। জানার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ রাজস্ব সার্কেল ও এসি ল্যান্ডকে বিষয়টি তদন্ত করে অপরাধীদের আটক করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছি। ’

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০ , ২০২৪
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।