ফেনী: ফেনীর সোনাগাজীর দক্ষিণাঞ্চলে ফেনী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিশাল চরাঞ্চল মৎস্য চাষের নামে দখল করে নিয়ে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ফলে আবহমান কাল থেকে চরাঞ্চলে বসবাসকারী গরু, মহিষ ও ভেড়ার শতাধিক খামারিরা চারণভূমি হারিয়ে বিপাকে পড়েছে।
অপরদিকে নদী ও খাল দখল হয়ে যাওয়ায় জেলেপাড়ার শত শত মৎস্যজীবী জেলে পরিবারগুলো তাদের আদি পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে না পেরে অসহায়ভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী, চরাঞ্চলের খামারিরা, উপকূলের জেলেরাসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের দিকে বড় ফেনী নদীর বাঁকা নদী সোজা করণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ফেনী নদীর দুই তীরে পলি জমে হাজারো একর জায়গায় নতুন চর জেগে ওঠে। নতুন চর জেগে ওঠায় স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সোনাগাজীর দক্ষিণাঞ্চলে চরাঞ্চলের দৃশ্যপট ও পাল্টে যায়। দেখা দেয় আশার আলো।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, এসব চরাঞ্চলের খোয়াজের লামছি, চর খোয়াজের লামছি, চর খোন্দকার, দক্ষিণ চর খোন্দকার, চর রাম নারায়ণ, চর এলেন, বাহির চর, পূর্ব বড়ধলী মৌজায় প্রায় ৪০ হাজার একর ভূমি (নতুন চর) জেগে ওঠে। নতুন চর জেগে ওঠায় এসব চরাঞ্চলে সরকার ‘সোনাগাজী শিল্পাঞ্চল’ ঘোষণা করে বেশ কিছু ভূমি স্থানীয় ভূমি মালিকদের থেকে অধিগ্রহণ করে নেয়।
অপরদিকে এসব চরাঞ্চলে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে সোনাগাজী, ফেনী ও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের স্থানীয় প্রভাবশালীদের।
৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের জেলা, উপজেলার নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী ও তাদের দলীয় বাহিনী নিয়ে এমপি প্রকল্প, এসপি প্রকল্প, ওসি প্রকল্প, মেয়র প্রকল্প, চেয়ারম্যান প্রকল্প, প্রবাসী প্রকল্প, আমেরিকা প্রকল্প, ফেনী মৎস্য প্রকল্প ইত্যাদি নাম না জানা নানা মৎস্য প্রকল্পের সাইন বোর্ড টাঙিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমিসহ বিশাল নদী-খাল ও চরাঞ্চলে পুকুর খনন করে দখল করে নিয়েছেন।
দখল-পাল্টা দখলের ঘটনায় চরাঞ্চলে বেশ কয়েকবার রক্তপাত ও সংঘর্ষের ঘটনায় তখন অশান্ত হয়ে ওঠে সোনাগাজীর চরাঞ্চল। স্থানীয় প্রভাবশালীদের চরাঞ্চল দখলের ফলে গরু, মহিষ ও ভেড়ার চারণভূমির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে।
সোনাগাজীর দক্ষিণাঞ্চলের প্রবীণ খামারি রুহুল আমিন ভূঁঞা, আনোয়ারুল কবির প্রকাশ কাবির মিয়া, ফকির আহম্মদ, নাজমুল হক, শামছুল হক, লাতু মিয়া, সমুন, বাহার মিঞাসহ শতাধিক খামারিরা তাদের এসব পশুর খামার নিয়ে বর্তমানে উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে।
এসব খামারিদের আদি পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় সম্পৃক্ত হতে বেকায়দায় পড়তে হবে। চরাঞ্চলের খামারিরা জানান, চরাঞ্চলের খামারের গরু, মহিষ ও ভেড়ার মাংস এবং দুধ এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে আসছে। সোনাগাজীর চরাঞ্চলের বিলুপ্তি ঘটলে ফেনী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশাল জনগোষ্ঠীর মাংস ও দুধের সংকট দেখা দেবে। ফলে এটি জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। থমকে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতির চাকা।
অপরদিকে সোনাগাজীর চর খোন্দকার গ্রামের জেলেপাড়ার জেলে প্রিয়লাল জলদাস, রাধেশ্যাম জলদাস, সুজন জলদাস, রতন জলদাস, মদন জলদাস ও তাদের পরিবার ক্ষোভ এবং হতাশা প্রকাশ বলেন, অনাদিকাল থেকে জেলেপাড়ার শত শত জেলে পরিবার ফেনী নদী ও খাল থেকে মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য গত ২ থেকে ৩ বছরে ফেনী নদীর একাংশ, শাখা খালগুলো প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাওয়ায় তাদের এখন দুর্দিন চলছে। অনেকের আয় রোজগারও বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয় লোকজন জানায়, প্রভাবশালীরা জোর করে চরাঞ্চলে মৎস্য ঘের তৈরি করে, পুকুর খনন করে হাজারো একর জমি দখল করে নেয়। এতে মৎস্যজীবী ও খামারিদের মাথায় হাত পড়ে। ইতোমধ্যে প্রভাবশালীদের হামলা ও হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য মৎস্যজীবীরা গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
এ বিষয়ে ইউএনও কামরুল হাসান জানান, ১১ জন দখলদারকে চিহ্নিত করা গেছে। বাকিদের বিষয়েও কাজ চলছে।
তিনি জানান, সোনাগাজীর চরাঞ্চলের প্রভাবশালীদের কবল থেকে সরকারি খাস এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি উদ্ধারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১২ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২৫
এসএইচডি/আরআইএস