ঢাকা: ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’, বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। যার অর্থ হলো, অপরাধীকে নীতির কথা শুনিয়ে কাজ হয় না, সে তার মতো চলে।
একইভাবে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে বই ও সিডি পাইরেসি করে বিক্রি করছে দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।
পাইরেটেড বইয়ের বাজার হিসেবে রাজধানীর নীলক্ষেতের নাম দেশ জুড়েই বিস্তৃত। দেশি-বিদেশি সাহিত্যকর্ম থেকে শুরু করে একাডেমিক বই, হেন কোনো বই নেই যার নকল এ বাজারে পাওয়া যায় না! তবে শুধু নীলক্ষেতই নয় বাংলাবাজারেও কিছু প্রকাশক রয়েছেন, যারা বিদেশি লেখকদের বই পাইরেসি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাম্প্রতিক সময়ের এমন কোনো বই নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। এখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের সমসাময়িক জনপ্রিয় লেখকদের পাইরেটেড বই খুব সহজেই পাওয়া যায়। ফলে এসব বইয়ের দামও তুলনামূলক অনেক কম।
বিদেশি এসব বই স্বল্প দামে বিক্রি হওয়ায় ক্রেতাও মিলছে দেদারসে। তবে একদিকে এটি যেমন পাইরেসি আইনের লঙ্ঘন, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
অবশ্য বিদেশি পাইরেটেড বইয়ের বিক্রেতা বা ক্রেতা, কারও মধ্যে এটি নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই।

ক্রেতাদের দাবি, তারা সস্তায় বিদেশি লেখকদের বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আর বিক্রেতারা বলছেন, তারা যদি এসব বই মুদ্রণ না করতেন, তাহলে অনেকের পক্ষেই এত দামি বই পড়ার সুযোগ হতো না।
বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) নীলক্ষেত বইয়ের বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতেই বিক্রি হচ্ছে এ পি জে আবদুল কালাম, চেতন ভগত, জওহরলাল নেহেরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, নেলসন ম্যান্ডেলা, বারাক ওবামা, বিল ক্লিনটন, টনি ব্লেয়ার ও ড্যান ব্রাউনের মতো নামি-দামি ব্যক্তিত্বের সব বই।
সেইসঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়সহ আরও অনেক লেখকের বিখ্যাত সব বই।
এছাড়া বইয়ের দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে চিকিৎসা শাস্ত্র, সমাজবিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে বিদেশি লেখকদের একাডেমিক বই।
এ বিষয়ে সোনালি মেডিকেল বুক হাউসের কর্মচারী আব্দুল কাদের বলেন, মেডিকেলের একটি বিদেশি মূল বইয়ের দাম কমপক্ষে দুই থেকে তিন হাজার টাকা। সেখানে আমরা বই বিক্রি করছি মাত্র তিন থেকে চারশো টাকায়। দেশিয় কোনো লেখকের বই আমরা কপি করি না।
তবে এর পাশাপাশি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবই বিক্রি করতেও দেখা গেছে। এসব বই বিক্রি করছে এনসিটিবি’র অনুমোদন না পাওয়া কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিস সবুর বলেন, বিদেশি লেখকের বই পাইরেসি অনৈতিক হলেও আমাদের জন্য সুবিধার। এসব বইয়ের যে চড়া দাম তাতে আমাদের পক্ষে মূল বই কেনা সম্ভব না। তাই নীলক্ষেতের কপিই ভরসা।
দিদারুল ইসলাম নামে অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, বইয়ের দাম কম এটি একদিকে যেমন ভালো, তেমনি অন্যদিকে সরকার প্রচুর রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। আবার এটি দেশের আইনেও অপরাধ।
পাইরেসি বই প্রসঙ্গে অঙ্কুর প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক রাশেদ আহমেদ বলেন, বিদেশ থেকে পাঠকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রতিবছর একশো কোটি টাকার উপরে বই আমদানি করা হয়। কিন্তু পাঠকরা সস্তায় এসব বইয়ের পাইরেটেড কপি পেয়ে সেগুলো কিনে ফেলেন। ফলে আমদানিকারকদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়।
তিনি আরও বলেন, শুধু ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে তাই নয়, সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। এছাড়া এটি পাঠকদের সঙ্গেও এক প্রকার প্রতারণা।
এদিকে, গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজার এলাকা ও ফার্মগেট ফুট ওভার ব্রিজের নিচে গিয়ে দেখা যায়, পাইরেটেড সিডির রমরমা ব্যবসা।
বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন সঙ্গীত শিল্পীদের পাইরেটেড এমপি থ্রি ও নাটকের সিডি। এক সিডিতে মিলছে গত রোজার ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘একজন রিকশাওয়ালা’, ‘পে ব্যাক’, ‘জান কুরবান’, ‘নাসের গ্যাং’, ‘অভিমান পর্ব’, ‘ডিস্টার্ব’সহ বিভিন্ন নাটকের সিডি। এছাড়াও রয়েছে বলিউড ও হলিউডের মিউজিক ভিডিও, গান ও সিনেমার পাইরেটেড সিডি।

ফার্মগেটে বাবুল নামে এক বিক্রেতাকে এসব সিডি বিক্রি অপরাধ জানালে তিনি বলেন, মামা মুই তো আর সিডি বানাইনি, এইডা যারা বানায় তাগোরে গিয়া কন। আমরা গরিব মানুষ ব্যবসা করে খাই, আমাগো ক্যান পুলিশে ধরবো।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাযহারুল ইসলামকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, নিয়মিতই এ এলাকায় অভিযান চালানো হয়। মাঝে মধ্যে মালামাল আটক করা হয়। তবে পুলিশ সেখানে যাওয়ার আগেই বিক্রেতারা পালিয়ে যায়।
পাইরেসি বন্ধে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে কপিরাইট আইন করে। ২০০৫ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়।
এ আইন অনুযায়ী, নাটক, সাহিত্য, অডিও-ভিডিও, চলচ্চিত্র, ফটোগ্রফি, ভাস্কর্য ও সম্প্রচার কর্মের স্বত্ব প্রণেতার মৃত্যুর ৬০ বছর পর্যন্ত বহাল থাকে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে কেউ কারও সৃষ্টিকর্ম নকল বা বিকৃত করলে পাইরেসি আইনের ৮২ ধারা মতে, সর্বোচ্চ চার বছর কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর ও অর্থদণ্ড পাঁচ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৫
এইচআর/এসএস