ঢাকা, সোমবার, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

ক্যারমে দেশখ্যাত দুই বোনের গল্প

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫
ক্যারমে দেশখ্যাত দুই বোনের গল্প ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাতক্ষীরা: দুই বোন। দু’জনই পারদর্শী ছিলেন দাবা, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিসে।

কিন্তু অপেক্ষাকৃত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে খেলার সুযোগ থাকায় যুক্ত হন ক্যারম খেলায়। তারা ক্যারমেই কাঁপিয়েছেন দেশ। সরব উপস্থিতি দেশের বাইরেও।

ক্যারমের দেশখ্যাত এ দুই বোন হলেন- ফারজানা বানু শিল্পী ও ফারহানা প্রীতি। দুই বোনে সমানে সমান। তাদের মধ্যে ফারজানা বানু শিল্পীকে ২০০৩ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত জাতীয় ক্যারমের শীর্ষ স্থান থেকে সরাতে পারেনি কেউ। তবে, বড় বোন শিল্পীর কারণে চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে বরাবরই বঞ্চিত থেকেছেন ফারহানা প্রীতি। তার অবস্থান বরাবরই রানার্স আপ। যদিও জুটিবদ্ধভাবে তারাই অপরাজিত।

১৯৯২ সাল। যখন ক্লাস নাইনে পড়তেন, তখন থেকেই ক্যারমে আকৃষ্ট হন সাতক্ষীরা শহরের মধ্য কাটিয়ার মৃত কাজী শায়াদাৎ হোসেনের মেয়ে ফারজানা বানু শিল্পী। বাবা এবং বড় ভাই কাজী শাফায়েত হোসেন বাপ্পীর সহযোগিতায় সেই সময় থেকেই অংশ নিতেন জেলা পর্যায়ের ক্যারম টুর্নামেন্টগুলোতে। সেই থেকে কখনোই ব্যর্থতা স্পর্শ করতে পারেনি তাকে। জেলা পর্যায়ের টুর্নামেন্ট, কলেজের প্রতিযোগিতা এমনকি জাতীয় ক্যারম টুর্নামেন্টসহ জাতীয় পর্যায়ের অন্যান্য টুর্নামেন্টেও আজ অবধি শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট তার। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যার কাছে ক্যারমের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের ইলাভারকি পর্যন্ত পরাস্ত হয়েছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষিকা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ফারজানা বানু শিল্পী ২০০৩ সাল থেকে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় ক্যারম টুর্নামেন্টে ধরে রেখেছেন শীর্ষ স্থান, চ্যাম্পিয়ন। এছাড়া, ছয় বার অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন দেশের ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত সার্ক ক্যারম চ্যাম্পিয়নশিপে, কয়েকবার অংশ নিয়েছেন এশিয়ান ক্যারম টুর্নামেন্টে এবং একবার খেলেছেন ওয়ার্ল্ড ক্যারম চ্যাম্পিয়নশিপে। আন্তর্জাতিক এসব টুর্নামেন্টেও অনন্য সাফল্যের দাবিদার তিনি। ছিলেন ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিং এ ৬-এ।

ঠিক একইভাবে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় ক্যারমে আকৃষ্ট হয়েছিলেন ফারহানা প্রীতি। জেলা পর্যায়ের টুর্নামেন্ট ও কলেজের টুর্নামেন্টগুলোতে তাকে হারাবে- এমন সাধ্য কারো ছিল না। তবে আপন বোন ফারজানা বানু শিল্পীর কাছে ঠিকই বার বার পরাজিত হতে হয়েছে জাতীয় ক্যারম টুর্নামেন্টের ফাইনালগুলোতে, সেখানে বরাবরই রানার্স আপ। যদিও ২০০৩ সালে খুলনার হাফিজুর রহমানের সাথে মিক্সড চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খ্যাতি রয়েছে তার।

বড় বোন ফারজানা বানু শিল্পী বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে অংশ নিলেও পড়াশুনার কারণে সে সুযোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রীতি। যদিও দেশের ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর সাতক্ষীরার এই কৃতি ক্যারমিস্ট।

প্রীতির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল নিজের বোনের কাছে পরাজিত হয়ে তার কেমন লাগতো। উত্তরে তিনি বলেন, আমারই তো বোন। অনেক চেষ্টা করতাম, কিন্তু কখনই হারাতে পারেনি। অবশ্য এর কারণ- আমরা একসাথে প্রাকটিস করতাম, এজন্য আপু আমার দুর্বল পয়েন্টগুলো সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানতেন।  

বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ফারজানা বানু শিল্পী তুলে ধরেন বাংলাদেশের ক্যারমের আদি-অন্ত। তিনি বলেন, আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন এতো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। জাতীয় ক্যারম ফেডারেশনও ছিল অসংগঠিত। আমরা যখন দেশের বাইরে যেতাম, তখন নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করতে হতো। ফেডারেশনের অজ্ঞতা ও অবহেলায় ২০১১ সালে আমেরিকায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড কাপ টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারিনি। একবার, মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত এক টুর্নামেন্টে রাত ৩টায় পৌঁছে সকাল ৯টায় খেলতে নেমেছিলাম।

বাংলাদেশের ক্যারমের সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশে সর্বশেষ ২০১২ সালে জাতীয় টুর্নামেন্ট হয়েছে। তারপর থেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সহ নানা কারণে আর কোনো টুর্নামেন্ট হয়নি। বাংলাদেশ ক্যারম ফেডারেশনের পরিসর ছোট হলেও অন্যান্য খেলার তুলনায় ক্যারমে অর্জন বেশি। কিন্তু ক্যারমের উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের গুরুত্ব কম।

তিনি ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভারত যুগ যুগ ধরে ক্যারমে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ওদের দেশে ক্যারামিস্টরা চাকরির মতো শিডিউল মেনে দিনে ৮ ঘণ্টা করে প্রাকটিস করে। যারা এই শিডিউলের আওতাভুক্ত ক্যারমই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। অন্য কোনো চিন্তা তাদের মাথায় থাকে না। আর আমি ও প্রীতি সমস্ত কাজ শেষে বিকেলে অথবা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক ঘণ্টা করে প্রাকটিস করতাম। ওদের প্রাকটিসের কাছে আমরা শিশু।

ফারজানা বানু শিল্পী জানান, ২০০৯ সালে ক্যারমে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের ইলাভারকি তার কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন। সে কি কান্না। অঝরে পানি ঝরেছিল তার চোখ দিয়ে। কারণ, ক্যারমে হার কি- সেটা ওরা বোঝে না।

তিনি বলেন, ভারতের খেলোয়াড়দের সাথে আমাদের খেলোয়াড়দের অনেক পার্থক্য রয়েছে। মনোযোগ ও কৌশল- এই দুইয়ে ক্যারমে সাফল্য আসে। ওরা খেলায় অত্যন্ত মনোযোগী। আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যেও যে কৌশল নেই, তা নয়। বরং ক্ষেত্র বিশেষ আমাদের আরো ভাল কৌশল আছে। আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের ভারতের মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে- আমাদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ নেই কারো। এ জন্য তিনি জেলা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক নিয়মে বেশি বেশি টুর্নামেন্ট আয়োজনের দাবি জানান।

তিনি বলেন, নিয়ম না জানার কারণে আমরাও প্রথমে অনেক ভুল করতাম। এক বোর্ডে ১৮টি পর্যন্ত গুটি খেলেছি। আন্তর্জাতিক নিয়মে বেশি বেশি টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারলে তৃণমূল থেকে অনেক ভাল ভাল খেলোয়াড় উঠে আসবে- এতে সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, এজন্য জেলা ক্রীড়া সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে হবে। ইনডোর গেমস বলে পিছিয়ে থাকলে চলবে না।

দীর্ঘ দুই বছর জাতীয় টুর্নামেন্ট না হওয়ায়, নিজেদের প্রিয় ক্যারম বোর্ড থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন দেশের এই সুপারস্টার ক্যারমিস্ট জুটি।

তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জাতীয় টুর্নামেন্ট হলে তারা আবার ফিরবেন কি না? উত্তরে শিল্পী বলেন, যদি কমপক্ষে এক মাস আগে জানতে পারি, তাহলে হয়তো ফেরা সম্ভব। তা না হলে নিজের চার বছরের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে ফেরাটা কঠিন। কারণ এখন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে নিয়মিত টুর্নামেন্ট হচ্ছে- প্রাকটিস ছাড়া শেষ পর্যন্ত টিকে থাকাটা অনেক কঠিন।

এ সময় তিনি একটি চিঠি দেখিয়ে বলেন, আইসিএফ কাপ ক্যারম টুর্নামেন্টের চিঠি এসেছে, প্রাকটিসের অভাবে যেতে পারবো না।

বাংলাদেশ সময়: ০১২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫ 
এমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।