ঢাকা: মোবাইল ফোনের সিম নিবন্ধনে শুরু হওয়া ব্যাপক কর্মযজ্ঞ মূলত অপরাধ কমাতেই নেওয়া হয়েছে। জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এটি করা হচ্ছে।
এমন দাবি ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের।
মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অপারেটর ও এনআইডি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠকের আগে-পরে নিবন্ধন কর্মযজ্ঞের তথ্য ও নিজেদের অবস্থান সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন তিনি।
তারানা হালিম বলেন, একজন নাগরিকও যেন অবৈধ সিমের কারণে ভোগান্তি বা নিরাপত্তাহীনতায় না পড়েন, সে লক্ষ্যে এ ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। জনগণের এ রাষ্ট্র যেন নিরাপদ থাকে, অপরাধ যেন কমে যায় এবং নাগরিকরা যেন স্বস্তিতে থাকেন- সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
তিনি বলেন, সমন্বিতভাবে আমরা কাজ করছি। এখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। আমরা পুরো বিষয়টিকে একটি সিস্টেমে আনতে চাই।
তারানা বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে তথ্য পরিবর্তিত হচ্ছে। আশা করি, কাজ শেষে আমরা একটি ভালো ব্যবস্থা পাবো।
মোবাইল অপারেটর, এনআইডি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এসব বিষয়ে একমত বলেও দাবি তার।
তিনি জানান, চূড়ান্তভাবে এ পদ্ধতি শুরু হলে প্রাধাণ্য পাবেন ফেক আইডির বিপরীতে সিম নিবন্ধনকারীরা এবং সঠিক এনআইডির বিপরীতে অস্বাভাবিকভাবে সিম নিবন্ধনকারীরা।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, এভাবে আশা করি, নিশ্চিত হতে পারবো সিমগুলো সঠিক মালিকই ব্যবহার করছেন। এ সম্পর্কিত তথ্যগুলো এনআইডি, মোবাইল অপারেটর ও কিছু ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, সামনে আরও কর্মযজ্ঞ হাতে নেবো। মানুষকে সচেতন করবো। অসচেতনতার দায়ভার নিয়ে চললে চলবে না। ব্লেইম গেম আর নয়। ডিসেম্বরের মধ্যে সবাইকে নিজের নিরাপত্তায় নিশ্চিন্ত হতে হবে।
সভাশেষে বের হওয়ার পথে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংক্ষেপে এমনটি বললেন গ্রামীণফোনের সিইও রাজীব শেঠীও।
রাজিব শেঠী বলেন, আমরা সবাই একসঙ্গে ভালো একটি ব্যবস্থার জন্য কাজ করছি। আশা করা যাচ্ছে, এতে দেশে অপরাধ অনেক কমে আসবে। আমরা সরকারের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছি।
নিবন্ধন তথ্য জমা দিচ্ছেন অপারেটররা
সভার শুরুতে সারাদেশের বিভিন্ন অপারেটরে মোট গ্রাহক সংখ্যা ও প্রাপ্ত ডাটার তথ্য (২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) জানিয়ে দেন তারানা হালিম।
প্রশ্নের জবাবে তারানা বলেন, ভ্যালিড ডকুমেন্ট পেয়েছি ৬ অপারেটরের ২৩ লাখ ৪৩ হাজার ৮০৭টি। যা প্রায় ২৫ শতাংশ।
এর আগে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সর্বমোট ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ ডাটা পেয়েছি।
গ্রামীণফোন ৫ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার গ্রাহকের মধ্যে নিবন্ধন তথ্য দিয়েছে ২২ লাখ গ্রাহকের, যা ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
এয়ারটেলের মোট গ্রাহক ৯০ লাখ ৮০ হাজার। ডাটা পাওয়া গেছে ১৪ লাখ ৪ হাজার ৯শ ৩৮টি, যা ১৫ দমশিক ৪৭ শতাংশ।
বাংলালিংকের মোট গ্রাহক ৩ কোটি ২৪ লাখ ৬ হাজার। ডাটা এসেছে ২৩ লাখ ৫৫ হাজার, যা ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ।
সিটিসেলের মোট গ্রাহক ১১ লাখ ৬১ হাজার। ডাটা এসেছে ৪ লাখ ১৪ হাজার ৮২৯টি, ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
রবির মোট গ্রাহক ২ কোটি ৭৯ লাখ ৬। ডাটা এসেছে ১৮ লাখ, যা ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
টেলিটকের ৪২ লাখ ২১ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ১৬ লাখ ৫৯ হাজার সিমের ডাটা পাওয়া গেছে, যা ৪৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
অবশ্য এ তথ্য দিয়েই অপারেটরদের মূল্যায়ন না করার অনুরোধ জানান তারানা হালিম। তিনি বলেন, কোন কোম্পানি শীর্ষে বা সর্বনিম্নে- এটি চূড়ান্তভাবে বলা এখনই সম্ভব নয়। এ সংখ্যা পরিবর্তিত হতে পারে যেকোনো সময়।
১৪ হাজার সিমের মালিক একজন!
একাই ১৪ হাজার সিমের মালিক! একটিমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে নিবন্ধিত করেছেন তিনি ১৪ হাজার ১১৭টি সিম। আতঙ্কিত ও বিস্মিত ভঙ্গিতে এমন তথ্যই জানালেন তারানা হালিম।
তিনি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে এয়ারটেল, জিপি, সিটিসেল, রবি, টেলিটক, বাংলালিংকের নিবন্ধনের চিত্র খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে ৬ অপারেটরের মোট ৬ হাজার ১৭৯টি নিবন্ধন পেয়েছি। একটি পরিচয়পত্রের বিপরীতে ১৪ হাজার ১১৭টি সিম নিবন্ধন পেয়েছি। এরকম আরও রয়েছে। আরেকটি এনআইডি’র বিপরীতে ১১ হাজার ৭২৮টি সিম নিবন্ধন হয়েছে। এগুলোর সবই ফেক আইডি।
সতর্কবার্তা
তারানা বলেন, ফেক আইডির মাধ্যমে বড় ধরনের অপরাধ হতে পারে। সবাইকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করছি। একজনের অপরাধের দায় নিরাপরাধী কারও ঘাড়ে এসে যেতে পারে।
ভ্যালিড ডকুমেন্ট ২৫ শতাংশ
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আজ যে পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন করছে, তার আর পরে ছাপ দিতে হবে না। ভ্যালিড ডকুমেন্ট পেয়েছি- ৬ অপারেটরের ২৩ লাখ ৪৩ হাজার ৮০৭টি, যা প্রায় মোট গ্রাহকের ২৫ শতাংশ।
অপ্রাপ্তবয়স্কদের দায় অভিভাবকের
প্রশ্নের জবাবে তারানা হালিম বলেন, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে তাদের সিম নেওয়ারই অনুমতি নেই। তবে যদি নেয়ও, তাদের অভিভাবক, মা-বাবা দায়িত্ব নেবেন। অভিভাবকের পরিচয়পত্রের বিপরীতে সিম নেবে এবং এ সিম দিয়ে যেকোনো অপরাধ হলে তার দায়ও পরিচয়পত্রের মালিকেরই।
১ নভেম্বর থেকে পরীক্ষামূলক বায়োমেট্রিক্স
মোবাইল ফোনের সিম নিবন্ধনে পরীক্ষামূলকভাবে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি (আঙুলের ছাপ) চালু হচ্ছে। আগামী ১ নভেম্বর থেকে মোবাইল অপারেটররা নিজেদের গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে এ পদ্ধতি চালু করবে।
তারানা হালিম বলেন, অপারেটররা তাদের কাস্টমার সার্ভিস সেন্টারে ১ নভেম্বর থেকে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি চালু করবেন পরীক্ষামূলকভাবে। সচেতন গ্রাহকরা নিজ উদ্যোগে এখানে এসে নিজ নিজ সিমের নিবন্ধন করতে পারবেন। তথ্যগুলোও যাচাই-বাছাই করতে পারবেন।
‘এছাড়া চূড়ান্ত ও বাধ্যতামূলকভাবে বায়োমেট্রিক্স কার্যক্রম শুরু হবে ১৬ ডিসেম্বর থেকে’- বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন- এমন করেই প্রচারণা চালানো হবে। তারপরও না করলে শেষ পর্যায় পর্যন্ত সুযোগ দিতে চাই। বৈধভাবেই অনেকে একাধিক সিম রাখেন, তাদেরও সুযোগ দিতে চাই। এরপরও না হলে বাধ্য হয়ে অকার্যকর করে দেওয়া হবে সিম।
জনপ্রতি সিমসংখ্যা চাহিদা বুঝে
প্রতিমন্ত্রী বলেন, জনপ্রতি কয়টি সিম রাখতে পারবে সেটি এখনো ঠিক করিনি। আগে দেখতে চাই, চাহিদা কতোটা। কর্পোরেট প্রয়োজনীয়তায় অনেক সময় একাধিক সিম রাখেন কেউ কেউ। কিন্তু ৬ হাজারতো কোনোভাবেই থাকতে পারে না।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক এনআইডি ব্যবহার করে এতো সিম কীভাবে হল, সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়।
এসএমএসে তথ্য যাচাই শুরু ১৫ অক্টোবর
তারানা হালিম বলেন, কেউ ফেক আইডি থেকে হাজার হাজার সিম নিবন্ধন করেছেন। আবার কারও আইডি ঠিক আছে, কিন্তু অস্বাভাবিক সংখ্যায় সিম নিবন্ধন করেছেন। এসব ভয়াবহ পরিস্থিতির ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ১৫ অক্টোবর থেকে এসএমএস পাবেন গ্রাহকরা।
২০১২ সালের আগে যেসব সিমের নিবন্ধন হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া, মোবাইল অপারেটররা সেসব গ্রাহককে এসএমএস পাঠাবেন। আইডি নম্বরসহ প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চাইবেন। একটি কোড থাকবে। গ্রাহকদের দেওয়া তথ্য অপারেটররা পাঠাবেন এনআইডিতে। সেখানে হবে যাচাই-বাছাই, এরপর চূড়ান্ত নিবন্ধন’- বলেন তিনি।
তারানা জানান, একটি কোডসহ অন্য এসএমএসে যেকোনো সময়ের গ্রাহকই চাইলে নিজের সিমের তথ্য যাচাই করে নিতে পারবেন। তার সিমটি আর কোথাও কেউ নিবন্ধন করেছে কি-না সেটিও নিজের নিরাপত্তার জন্য জেনে নেওয়া যাবে।
তিনি বলেন, যাদের রেজিস্ট্রেশন ঠিক আছে, তাদের এখন ইনভলভ করছি না।
‘এনআইডি অ্যাক্সেস’ পাচ্ছে মোবাইল অপারেটররা
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি পরিচয়পত্রের বিপরীতে হাজার হাজার সিমের নিবন্ধন হয়েছে। এক্ষেত্রে মোবাইল ফোন অপারেটররা একটি সঙ্গত যু্ক্তি দেখিয়েছেন। তাদের এনআইডি অ্যাক্সেস নেই।
তারানা বলেন, এনআইডি ও মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে একটি এমওইউ (সমঝোতা) সাইন করা হবে।
তিনি বলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পরে বায়োমেট্রিক্স চালু, অস্বাভাবিক নিবন্ধন বা অনিয়মে অপারেটররা জবাবদিহিতা করবেন।
এ বৈঠকে মোবাইল অপারেটর প্রতিনিধি, এনআইডি প্রতিনিধি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এমওইউ’র তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে খুব দ্রুত সময়ে করা হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
এ পর্যায়ে উপস্থিত মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিনিধিরা জানান, স্বাক্ষরের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তারা ইতোমধ্যে জমা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৫
এসকেএস/এএসআর
** ‘এনআইডি অ্যাক্সেস’ পাচ্ছে মোবাইল অপারেটররা
** ১ নভেম্বর থেকে পরীক্ষামূলক বায়োমেট্রিক্স
** এসএমএসে সিমের তথ্য যাচাই শুরু ১৫ অক্টোবর
** ১৪ হাজার সিমের মালিক একজন!