ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

ভিক্ষুক যখন মাংস বিক্রেতা!

বেলাল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৫
ভিক্ষুক যখন মাংস বিক্রেতা! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বগুড়া: জোবেদা বেওয়া। বয়স সত্তর পেরিয়ে আশির কোটা ছুঁই ছুঁই করছে।

কানেও শুনতে পান না। বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কাবিলপুর গ্রামে। ছেলে মেয়েরা অনেক আগেই তাকে ত্যাগ করেছেন। স্বামীও পরপারে চলে গেছেন। তাই এ বয়সেও তাকে চালাতে হচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াই।
 
সংসারে প্রচণ্ড অভাব। জীবিকার সন্ধানে পাড়া-মহল্লায় এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়ান তিনি। এভাবে ভিক্ষের টাকায় চলে তার সংসার। কোরবানির দেওয়ার সামর্থ্য নেই তার। কিন্তু ভিক্ষুক হলে কি হবে? মাংস খাওয়ার সাধ তো ঠিকই জাগে। কারণ গরিবেরও তো সাধ-আহলাদ আছে।
 
তাই সামান্য মাংসের জন্য ঈদের দিন শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) কাকডাকা ভোরে বাড়ি থেকে বের হন। অনেক অভাবি, ফকির- মিসকিনের সঙ্গ ধরেন তিনি। ট্রেনযোগে চলে আসেন বগুড়ায়। সারাদিন শহরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কোরবানির মাংস ওঠান। এভাবে প্রায় ৮-৯ কেজি মাংস সংগ্রহ করেন তিনি।
 
এরপর তা নিয়ে আসেন রেলওয়ে স্টেশন এলাকায়। ভিক্ষুক বনে যান মাংস বিক্রেতায়! সেখানে অপেক্ষারত ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেন সিংহভাগ মাংস। সামান্য মাংস নিজের খাওয়ার জন্য রেখে দেন। প্রতি কেজি মাংসের দাম পান ২৫০ টাকা দরে।  
 
কোরবানি ঈদের এই দিনটিতে এখানে এ রকম শত শত ভিক্ষুক ফকির মিসকিন মাংস বিক্রি করতে আসেন। ক্ষণিকের জন্য তারা হয়ে যান মাংস বিক্রেতা। আর এসব মাংস বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার তুলনামূলক স্বল্প আয়ের মানুষ, ছোট ছোট হোটেল মালিক, লটপটি ব্যবসায়ীরা কিনে থাকেন।
 
তবে এসব মানুষের হাতে ভিক্ষুকের মাংস পৌঁছার আগেই সিংহভাগ মাংসই স্টেশন এলাকায় বসে থাকা মৌসুমী ব্যবসায়ী স্বল্প দামে কিনে নেন। পরে তারা সেই মাংস প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করেন।
 
শুক্রবার শহরের রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় গিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাসহ একাধিক হতদরিদ্র অসহায় মানুষের সঙ্গে কথা হলে এসব তথ্য ওঠে আসে।
 
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, প্রায় দুই যুগ আগে থেকে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় আশেপাশেরসহ বহু দূর-দূরান্তের দুঃস্থ অসহায় মানুষজন এসে কোরবানির মাংস বিক্রি করে থাকেন।
 
এ সুযোগে এখানে একশ্রেণির মৌসুমী মাংস ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছে। এ রকম ব্যবসায়ীর সংখ্যা অর্ধশতের মতো হবে। আর প্রত্যেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কমপক্ষে ৪-৫ জন করে সহযোগী রয়েছেন। তারা স্টেশন এলাকায় প্রবেশ পথগুলোতে অবস্থান নিয়ে থাকেন।
 
মাংসের ব্যাগ হাতে কোনো মানুষকে আসতে দেখলেই তারা সেদিকে এগিয়ে যান। সাধারণ ক্রেতা পৌঁছার আগেই তারা কম দামে তাদের কাছ থেকে সেই মাংস কিনে নেন। এসব মৌসুমী ব্যবসায়ী প্রতি কেজি মাংস ২৪০-২৫০ টাকা দরে কেনেন। আবার সেই মাংসই তারা ক্রেতা সাধারণের কাছে ৩৪০-৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন।
 
আমিনুল ইসলাম, ভুট্টো, শাহিন, আবুল হোসেন, আব্দুল জব্বার, হোসেন আলীসহ একাধিক মৌসুমী ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান, বুঝ হওয়ার পর থেকেই তারা এখানে এভাবে মাংস কেনা-বেচা দেখে আসছেন। প্রত্যেক কোরবানি ঈদে দুপুর তিনটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত এ এলাকায় এসব মাংস বেচা বিক্রি হয়।
 
তারা আরও জানান, বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলাসহ গাইবান্ধা, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, বোনারপাড়া এলাকার দুঃস্থ অসহায় শ্রেণির মানুষজন ভোরের ট্রেনে এ শহরে আসেন। পরে রেলওয়ে স্টেশনে নেমে তারা ৮-১০ জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়েন।
 
এরপর সারাদিন তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাংস ওঠান। পরে ব্যাগে ভরে সেই মাংস এখানে বিক্রি করে রাতের ট্রেন ধরে বাড়ি চলে যান। ছোট ছোট হোটেল ব্যবসায়ী, লটপটি ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এসব মাংস কিনে থাকেন বলেও তারা জানান।
 
হালিমা, আনোয়ারা, পাদা, সাইফুল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম অসহায় ও দুঃস্থদের কয়েকজন। তারা বাংলানিউজকে জানান, দিন শেষে তারা প্রত্যেকে প্রায় ৬-৭ কেজি করে মাংস সংগ্রহ করেছেন। কিছু পরিমাণ নিজেদের খাওয়ার জন্য রেখে পুরোটা এখানকার দোকানিদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রায় আট দশ বছর ধরে তারা এ কাজ করেন।
 
চাকরিজীবী ক্রেতা রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, তিনি সামান্য বেতনের চাকরি করেন। তাই এই উর্ধ্বমূল্যের বাজারে তার পক্ষে কোরবানি দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে বাধ্য হয়ে এখানে মাংস কিনতে এসেছেন। তিনি ১ হাজার ৮৫০ টাকা দিয়ে সাড়ে ৭ কেজি গরুর মাংস কিনেছেন। যা পরিবার পরিজন নিয়ে খাবেন।
 
শাজাহানপুর উপজেলার সাবরুল গ্রাম থেকে আসা ক্রেতা আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে জানান, স্ত্রী ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সেই সংসারে তীব্র অভাব। দিনমজুরি করে তার সংসার চলে। কিন্তু একমাত্র ছোট্ট মেয়ে জেদ ধরেছে, সে কোরবানির মাংস খাবে।
 
তাই স্বল্পদামে এখানে মাংস কিনতে এসেছেন। বহু চেষ্টার পর ২৪০ টাকা কেজি দরে তিনি দেড় কেজি মাংস এক বৃদ্ধা নারীর কাছ থেকে কিনতে সক্ষম হন।
 
বিকম পাস করেছেন শাহিন। এখনও পড়াশোনা করছেন। তাই বেকার হওয়ার কারণে তার পক্ষে কোরবানি দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না। কিন্তু সবার ইচ্ছে কোরবানির মাংস খাওয়া। তাই বাধ্য হয়ে এখানে এসেছেন।
 
কিন্তু এখানেও সমস্যা। মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কারণে মূল বিক্রেতার কাছে পৌঁছাই চরম কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। অনেক কষ্টে হালিমা নামের একজনকে অনুরোধ করে থামান। তার কাছ থেকে ২৫০ টাকা কেজি হিসেবে ৫ কেজি মাংস কিনে বাড়ি ফেরেন বেকার এই যুবক।     
 
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘন্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৫
এএসআর/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।