ঢাকা: আদরের একমাত্র কন্যা আফরোজা আক্তার বৃষ্টির পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো শুক্রবার। বাড়িতে এমনিতেই শোকের আবহ।
বৃহস্পতিবার সৌদি আরবের মিনায় ‘শয়তান স্তম্ভে’ পাথর ছোঁড়ার সময় পদদলিত হয়ে নিহত হন ৭১৯ জন হাজি। আহত হন ৮৬৩ জন।
সেই ঘটনার পর থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত কোন সন্ধান মেলেনি সাভার পৌরসভার দুই বারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী আমিনুর রহমান (৪৭) ও তার সহধর্মিনী আলেমা বেগমের (৪৩)।
তাদের সঙ্গে থাকা অন্যরাও জানাতে পারেননি তাদের কোন তথ্য। পরিবারটিতে এখন কেবল কান্না আর আহাজারি।
আমিনুর রহমান আগেও হজ পালন করেছেন। এবার গিয়েছিলেন সস্ত্রীক। তার হাজী শনাক্তকরণ নম্বর -০২৩৫০৯৫। আর পাসপোর্ট নম্বর বিই-০৬১২৯৫০। অন্যদিকে আলেমা বেগমের হাজী শনাক্তকরণ নম্বর- ০২৩৫০৯৬, আর পাসপোর্ট নম্বর-এএফ ৩৫৪১৮৭৫।
এজেন্ট দি সিটি ট্রাভেলসের মাধ্যমে তারা গিয়েছিলেন হজ পালনে। তাদের গাইড ফয়েজ আহমেদ ও বাংলাদেশের মোয়াল্লেম মুফতি শামছুর রহমান, সৌদি আরবের মোয়াল্লেম হাফেজ নূর মোহাম্মদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেও পাওয়া যায়নি কোন খোঁজ।
সাভার পৌরসভার ৩৮, কর্ণপাড়ার বাসিন্দা হাজী আব্দুস সাত্তারের ছেলে কাউন্সিলর আমিনুর রহমান থাকতেন প্রতিবেশী কাতলাপুর এলাকায়।
দুই সন্তান আরিফুর রহমান আরিফ (২৪)ও আতিকুর রহমান আসিফকে (২৩) নিয়েই আমিন দম্পত্তির সংসার।
কাতলাপুর ও কর্ণপাড়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে বিলীন ঈদের আনন্দ। গোটা পরিবেশজুড়ে থমথমে ভাব। উৎকন্ঠা আর উদ্বেগের চাদরে ঘিরে রেখেছে গোটা মহল্লার পরিবেশ। কান্না আর আহাজারিতে সৃষ্টি হয়েছে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি।
সেখানে সংবাদমাধ্যম কর্মী পরিচয় জেনে উল্টো প্রতিবেশীরা জানতে আসেন কোন খোঁজ পেয়েছি কি’না।
তবে দিন যাচ্ছে আর অনিশ্চয়তা ভর করছে পরিবারটিতে।
আহতদের তালিকায় নাম না থাকা, এমনকি হাসপাতালে কোন খোঁজ না পেয়ে দু:সংবাদকেই বরণ করতে হয় কি’না সেই আতংকে রয়েছে পরিবারটি।
পরিবারের অনেক সদস্যই দেখছেন নিখোঁজ হবার আগে আমিন দম্পত্তির সামাজিক মাধ্যমে তুলে দেয়া ছবিগুলো। এদিকে সস্ত্রীক মিনায় নিখোঁজ জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধির সন্ধানে সরব সাভারের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।
বাবা মায়ের সঙ্গে থাকা ছবি জুড়ে দিয়ে আতিকুর রহমান আসিফ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, এখনো আমার আব্বু-আম্মুর কোন খোঁজ পাইনি। সবাই দোয়া করবেন।
পরিবারের ছোট ছেলে আসিফ বাংলানিউজকে বলেন, বুধবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বাবা ও মায়ের সঙ্গে কথা হয়।
প্রথমে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কোরবানির জন্যে কয়টি গরু আর কয়টি খাসি কিনেছি। তারপর দাদার প্রতি যত্ন নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিলেন। চারটি পুকুরের মাছের খাবার ঠিকমতো দেয়া হয় কি-না জানতে চাইলেন।
ফোনটি মা এর হাতে দেবার পর প্রথমেই মা বড়ভাইসহ আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলেন, পাঞ্জাবি কিনেছি কিনা?
এক পর্যায়ে বললেন, বাবা ফোনে চার্জ নেই। কাল কংকর ছুঁড়ে তাওয়াফ করে তোমাদের ফোন দেবো।
তারপর দিন বৃহস্পতিবার সৌদি আরবে ঈদ। আমি বেলা ১১টার দিকে বাবাকে ফোন দিলাম। দেখি মোবাইলটি বন্ধ। তারপরই জানতে পারি সেই দুসংবাদ। এখন আমাদের নাওয়া-খাওয়া নেই। ঈদ তো নেইই।
আমিনের বৃদ্ধ বাবা হাজী আব্দুস সাত্তার বাংলানিউজকে বলেন, দুইদিন ধইরা পোলা বৌমার কোন খবর পাই না। টিভিতে খালি লাশ দেখি, বুকের মধ্যে জইম্যা থাকা কান্না সামাল দিবার পারি না। কি বুঝ দিমু নাতি দুইডারে?
কথা হয় আমিনের হজসঙ্গী সাভারের যুবলীগ নেতা সোহেল রানার সঙ্গে।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ওই ঘটনার ১৫ মিনিট আগে আমার মুঠোফোনে নিজেরা কিছু ভিডিও করি।
তারপর আমরা কোনমতে বেঁচে ফিরলেও তাদের কোন খোঁজ পাইনি।
সঙ্গে থাকা সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম, আমিনের গলায় বোধহয় কোন আইডি কার্ড ছিলো না। পরে সোহেলের ভিডিও দেখে নিশ্চিত হই তার গলায় আইডি কার্ড ও ব্যাগ ছিলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কোন খোঁজ আমরা পাইনি।
কথা হয় একই এজেন্টের মাধ্যমে যাওয়া আমিনের সঙ্গী আশরাফ উল্লাহ চৌধুরী সাইফুলের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এতবড় দুর্ঘটনার পর মিনায় বিরাজ করছে চরম ভীতিকর পরিবেশ। আমরা এখনো নিশ্চিত না, ঠিক কি ঘটেছে আমিন দম্পত্তির ভাগ্যে। আমরা হাসপাতালে ঘুরেও এখনো তাদের কোন খোঁজ পাইনি। এমনকি আহতদের তালিকাতেও নাম পাইনি আমিন দম্পত্তির।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৫
জেডএম/