ময়মনসিংহ: দিন তিনেক আগে মমতাময়ী মা সেলিনা বেগমের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল আদরের ছেলে আশরাফুল করিম রোকনের (২৬)। সেইদিন মা বলেছিলেন, ‘বাবা আরাফাতের ময়দানে যাচ্ছি।
সেই কথাটি বারবার কানে বাজছে রোকনের। মুহূর্তেই জলে ভিজে আসে দু’ চোখ। নিজেকে আর ঠিক রাখতে না পেরে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। আবার ভেজা চোখ মুছে আকুল কন্ঠে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলেন, ‘তিনদিন ধরে মা’র কোনো খোঁজ নেই। বেঁচে আছেন কী না তাও জানতে পারছি না। আব্বু বলছে তোমরা টেনশন করো না। তোমার আম্মুকে পাওয়া যাবে। ’
শনিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ময়মনসিংহের ত্রিশালের চরপাড়া এলাকায় বড় বোন কানিজ ফাতেমা রুবি’র বাসায় বসে বাংলানিউজের সঙ্গে রুকনের কথা হয়।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সৌদি আরবের মিনায় ‘শয়তান স্তম্ভে’ পাথর নিক্ষেপ করার সময় পদদলিতের ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ হন মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জহির উদ্দিন (৬০) ও তার স্ত্রী সেলিনা বেগম (৪০)।
রুকন জানান, এরপর বাবাকে একটি মিনার একটি স্থানীয় ক্লিনিকে পাওয়া গেলে মাকে পাওয়া যায়নি। তিনি বেঁচে আছেন কী না তাও জানেন তারা।
মায়ের চিন্তায় অনিদ্রা আর অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে চার ভাই-বোনসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের। সেলিনা বেগমকে জীবিত ফিরে পেতে গোটা পরিবার এখনও আকুল হয়ে আছেন।
আলাপের শুরুতে আশরাফুল করিম রোকন বলেন, শয়তান স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপের সময় গরমের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ ছিল। প্রচণ্ড গরমে আম্মার শরীর দুর্বল হয়ে যায়। মানুষের হুড়োহুড়ির মাঝে আব্বা আম্মার হাত শক্ত করে ধরেছিলেন।
‘তাদের সঙ্গে থাকা মোয়াল্লেম ধাক্কা খেয়ে দূরে সরে যায়। আব্বা-আম্মা দু’জনেই অজ্ঞান হয়ে যান। পরে আব্বা নিজেকে একটি ক্লিনিকে আবিষ্কার করলেও সেই থেকে আম্মার কোনো সন্ধান নেই। আব্বু সেখানে আম্মার খোঁজ করছেন,’ বলেন তিনি।
রুকন জানান, মিনায় তাদের পরিচিত ২/৩ জন গেছে, তাদের দিয়েও খোঁজ করা হচ্ছে। কিন্তু কেউ-ই সন্ধান দিতে পারছেন না।
‘আব্বার সঙ্গে আজও কয়েকবার ভিডিও কলে কথা হয়েছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আব্বার মানসিক অবস্থা ভালো না। তিনি আমাদের বারবার আশ্বস্ত করছেন আম্মুকে পাওয়া যাবে। ’
নিখোঁজ সেলিনা বেগমের বড় ছেলে ইনামুল কবির রানাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। দু’ বোন কানিজ ফাতেমা রুবি (২৮) ও মারিয়া জহির সূচি (১৫) মায়ের জন্য কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন।
তাদের বুকফাটা আর্তনাদে রুদ্ধশ্বাস ত্রিশালের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পরিবেশ।
সরেজমিনে এ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মায়ের নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে পরিবারটিতে ঈদের কোনো আনন্দ নেই। পরিবারের সদস্যদের এ কান্না ছুঁয়ে গেছে কাছের মানুষ থেকে দূরের মানুষজনকেও।
নিখোঁজ সেলিনা বেগমের বড় ছেলে ইনামুল কবির রানা বলেন, ‘এবারের ঈদ আমাদের কাছে অর্থহীন মনে হয়েছে। বারবার আব্বার সঙ্গে আম্মার নানা স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমাদের মা জীবিত আছেন কিনা এটাই নিশ্চিত হতে পারছি না। ’
দূতাবাসের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে যেন দ্রুত খোঁজ খবর নেওয়া হয়। যেন নিখোঁজরা কীভাবে আছেন, কোথায় আছেন তা সবাইকে জানানো হয়। ’
নারীদের কাফেলাতে সার্চ অভিযানেরও দাবি জানিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে ত্রিশাল উপজেলা’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিকন তং চং গা’র সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। ’
নিখোঁজ লতিফ-জাহানারা দম্পতি
মিনায় পদদলিত হয়ে এ উপজেলার আরও এক দম্পতি নিখোঁজ রয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তাদের স্বজনরা।
তারা হলেন-লতিফুর রহমান (৬০) ও তার স্ত্রী জাহানারা বেগম (৫০)। তাদের বাড়িও চরপাড়া এলাকায়।
নিখোঁজ বাবা-মা’র কথা জিজ্ঞাসা করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাদের মেয়ে বুলবুলি।
বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দিনই বিকেলে যখন টিভিতে দেখি অনেক লোক মারা গেছে। মোয়াল্লেমের কাছে কল দিই। কেউ ধরে না। পরে সেখানে এক চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফোন দিই। পরে সে বলেছে- পদদলিত হয়ে অনেক লোক মারা গেছে। ’
বুলবুলি বলেন, ‘৩ দিন ধরে আমার আম্মা-আব্বার কোনো খোঁজ পাই নাই। তাদের যেভাবে সৌদি পাঠাইছি, সেইভাবে ফেরত চাই। আমাদের ভাই নাই। আমরা দুই’টা বোন। তাদের কিছু হইলে আমাদের কী হইবো। ’
বাংলাদেশ সময়: ২১৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৫
এমএ/