পটুয়াখালী: বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। দেশের দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর শেষ প্রান্তে কুয়াকাটার অবস্থান।
পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের একাংশ জুড়ে কুয়াকাটার অবস্থান। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের তিন দিকে বঙ্গোপসাগর। উপকূলজুড়ে বনভূমির শীতল পরশ, সমুদ্র সৈকতের মায়াবী পরিবেশ প্রেম জাগিয়ে তোলে সবার মনে। ঠিক এ রকমই স্বপ্নময় রহস্য ঘেরা স্থান কুয়াকাটা।
অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটা
কুয়াকাটার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বন বিভাগ। এখানে বন বিভাগের অধীনে প্রায় ১৪ হাজার একর বন রয়েছে। এখান থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যাওয়া যায় ফাতরার চর। সময় লাগে এক ঘণ্টা। ফাতরার চরে ১০ হাজার একর জমিতে রয়েছে বন। এখানে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ কেওয়া, সুন্দরী, বাইন, কাকরা, গরান, তেহাল ও গোলপাতা গাছ রয়েছে। এই বনে দেখা যাবে হরিন, বানর, মেছে বাঘ, বন্য শূকর, শিয়াল।
![](files/September2015/September27/patuakhali_kuakata_pic_14_958530692.jpg)
শীতকালে অতিথি পাখি-কোরানী হাঁস, বালি হাঁস, বন বক, পান কৌড়ি, জল কবুতর, গাংচিল, রাজহাঁস, চখা, কাইমা, হরিয়ানসহ নানা জাতের পশু পাখির কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠে ফাতরার চর। এ সকল পাখির অধিকাংশ আসে সাইবেরিয়া থেকে। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, ফিলিপাইন, চীন, মালদ্বীপ থেকেও এসব পাখি আসে। সমুদ্র সৈকতে থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ফাতরার চরটি সমুদ্রের ভেতরে। বনের মধ্যে পা’য়ে হেঁটে ঘোরাফেরা করে আর সারিবদ্ধ গাছ দেখেই মিতালী হয়ে যাবে গাছের সঙ্গে।
কুয়াকাটার নামকরণ
সরকারের রাজস্ব বিভাগে কুয়াকাটা বলতে কোনো মৌজার নাম নেই। অথচ সাগরের বেলাভূমি কুয়াকাটা নামে পরিচিত। কুয়াকাটা নামকরণে রাখাইনদের ইতিহাস জড়িত। রাখাইনরা আগে দেব-দেবীর পূজা করতেন। পরে তারা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হন। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মিজ রাজা বোদ্রোপা আরকান জয় করে রাখাইনদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়।
বর্মী সেনার নৃশংসতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য রাজ্যের মেঘাবর্তী হতে ১৫০টি রাখাইন পরিবার বার্মিজদের হাত থেকে মুক্তির জন্য ৫০টি নৌকায় তিনদিন তিনরাত বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা থানাধীন মৌডুবি এলাকায় উপস্থিত হন। উক্ত অঞ্চলটি তখন বন জঙ্গলে ভর্তি ছিল। বনের হিংস্র জীব জন্তুর সঙ্গে যুদ্ধ করে জঙ্গল কেটে পরিস্কার করে ধান ফল-মূলের বীজ বপণ করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করল।
এভাবে পটুয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠলো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের ইতিহাস। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে তারা ছড়িয়ে পড়লে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায়। তারা অবস্থান নিলেন কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের সাগর পাড়ে। সমুদ্রের পাড়ে যখন রাখাইন আসলো তখন পানির অভাব দেখা দিল।
![](files/September2015/September27/patuakhali_kuakata_pic_10_928910409.jpg)
মিঠা পানির আশায় সমুদ্রের প্রায় কাছে ছোট একটি কুয়া খনন করল। কুয়াটি গোল এবং গভীর। ওই কুয়া থেকেই রাখাইনরা পানির অভাব দূর করলো। কুয়াটি সবার কাছে প্রয়োজনীয় বলে পরিচিতি লাভ করলো। কুয়াটি কাটার (খনন) কারণেই কুয়াটির চারপাশের বিরাট অংশটি কুয়াকাটা নামে দেশে ও বিদেশে পরিচিত।
একই স্থানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে সামনে সীমাহীন সমুদ্র। পিছনে গোটা বাংলাদেশ। বামে অর্থাৎ পূর্বে ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার আর ডানে অর্থাৎ পশ্চিমে বরগুনা, বাগেরহাট, খুলনা আর সুন্দরবন। সমুদ্রের পানিতে ডুবাডুবি করে ক্লান্ত হয়ে সৈকতে রঙ-বেরঙের ছাতার নচে হেলান চৌকিতে বিশ্রাম নিয়ে আবার পানিতে ঝাপিয়ে পড়া যাবে।
সমুদ্র ভ্রমণের জন্য ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। এসব নৌকা ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া দেয়। সৈকতে চটপটি, চা, ডাব পানের ব্যবস্থা রয়েছে। অনেককে গাড়ি নিয়ে ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ ও ৩ কিলোমিটার প্রস্ত বেলা ভূমির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দৌঁড়াতে দেখা যায়।
সকাল ও বিকেলে পর্যটকদের সমাগম বেশি থাকে এখানে। বনভোজনের তো লেগেই থাকে। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র/ছাত্রীরা এখানে আসে শিক্ষা সফর এবং বনভোজনের উদ্দেশে।
![](files/September2015/September27/patuakhali_kuakata_pic_8_124063650.jpg)
বিকেলে সৈকতের যেকোনো স্থান থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। তবে সূর্যোদয় দেখতে হলে যেতে হবে পূর্বে দিকের ঝাউবনের কাছে। খুব ভোরে পা’য়ে হেঁটে অথবা ভ্যানে যেতে পারেন। আগের দিন বিকেলে ভ্যান ঠিক করলে খুব সকালে ভ্যান চালক সময় মতো আপনার হোটেলে অথবা ডাক বাংলোতে এসে আপনাকে নিয়ে যাবে।
দেখবেন ভোরের সূর্য সমুদ্রের মধ্য থেকে আস্তে আস্তে সোনার থালার মতো গোল হয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করছে। সৈকতে ঢোকার রাস্তার দু’পাশে রয়েছে ছোট খাট সাজানো দোকান। দোকানগুলোতে খুব বেশি দামি জিনিসপত্র না থাকলেও পছন্দনীয় অনেক কিছু পাওয়া যায়।
রাতে রঙ বেরঙের টিউবের আলোতে সাজানো দোকানের জিনিসগুলোকে দেখতে অপূর্ব লাগে এবং কিনতে ইচ্ছা করবে আপনার প্রিয়জনদের জন্য ছোট-খাট উপহার। মূল্য যতই কম হউক না কেন কুয়াকাটার জিনিস বলে ভাল লাগবে সবার কাছে।
এছাড়াও পাশেই রয়েছে রাখাইন নারী মার্কেট যেখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি জামা-কাপড়, লুঙ্গি প্রসাধনী। মোটকথা কুয়াকাটা এখন শুধু মনোলোভা সমুদ্র সৈকত নয়, সীমাহীন সম্ভাবনাময় ব্যবসায়ীক কেন্দ্র।
![](files/September2015/September27/patuakhali_kuakata_pic_5_361369356.jpg)
বিশাল বৌদ্ধ মন্দির
কুয়াকাটার ঐতিহাসিক কুয়ার পাশেই রয়েছে রাখাইনদের বিশাল বৌদ্ধ মন্দির। গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি রয়েছে বিশালকার বেদির ওপর বসানো। মূর্তিটির সৌন্দর্য সৌকর্য ইন্দচীনের মন্দিরটি সোনা, রূপা পিতল, কাসা, তামা, লোহা, সীসা, পারদ ও দস্তার মোট নয়টি ধাতুর তৈরি সাড়ে সাইত্রিশ মণ ওজন এবং প্রায় ১০ ফুট উঁচু। তাই মূর্তিটিকে নবম ধাতুর মূর্তি বলা হয়।
১৯২৫ সালে মূর্তিটি প্রথম পঞ্চায়েত পাড়ায় স্থাপিত হয় পরে ১৯৬৬ সনে মূর্তিটি বর্তমান জায়গায় স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে মিশ্রিপাড়া এলাকায় এশিয়ার সর্ববৃহত্তম আরেকটি বৌদ্ধ মন্দির আছে। যার নাম সীমা বৌদ্ধ বিহার।
কুয়াকাটায় যাওয়া এবং থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা
কুয়াকাটা যাবার অনেক পথ খোলা আপনার সামনে। ঢাকা থেকে কুয়াকাটা সরাসরি বিআরটিসি, সাকুরাসহ অনেক কোম্পানির পরিবহনের একাধিক বাস সকাল-সন্ধ্যা চলাচল করছে। যশোর, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর থেকেও সরাসরি কুয়াকাটায় গাড়ি চলছে। ঢাকা থেকে স্টিমার অথবা বিলাস বহুল এসি/নন এসিসহ যাত্রীবাহী ডাবল ডেকারের লঞ্চ প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছেড়ে যায় বরিশালে।
![](files/September2015/September27/patuakhali_kuakata_pic_18_806293289.jpg)
বরিশাল থেকে বাসে কুয়াকাটা। সবচেয়ে আরামে আসার পথ হলো ঢাকা থেকে সন্ধ্যায় লঞ্চে উঠলে ভোর ৫-৬ টায় পটুয়াখালী। তারপর পটুয়াখালী থেকে সড়ক পথে কুয়াকাটা। বরিশাল থেকে কুয়াকাটায় একমাত্র সড়ক পথে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা আর পটুয়াখালী থেকে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টায় যাওয়া যায়।
তবে, পটুয়াখালী থেকে ৭২কিলোমিটারের সড়ক পথে আপনাকে ২টি ফেরিতে কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
কুয়াকাটায় বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারিভাবে থাকা ও খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হলিডে হোমস নামে একটি মোটেল রয়েছে। এই মোটেল শীতাতপ নিয়ন্ত্রণসহ বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালী জেলা পরিষদের ২টি ভিআইপি ডাকবাংলো রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগের ২টি রেস্ট হাউস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ১টি এবং রাজস্ব বিভাগের রয়েছে ১টি রেস্ট হাউস।
এছাড়াও বেসরকারিভাবে বহু হোটেল ও রেস্ট হাউস গড়ে উঠছে। এগুলোর মধ্যে অনেক হোটেল ভিআইপি এবং ভিভিআইপি ভাবে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি হোটেলই এসি এবং ননএসির ব্যবস্থাসহ আধুনিক সব রকমের সুযোগ সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে অত্যাধুনিকভাবে তৈরিকৃত ৪টি হোটেল সবার দৃষ্টি কাড়ে।
![](files/September2015/September27/patuakhali_kuakata_pic_1_391932603.jpg)
হোটেলগুলো হচ্ছে কুয়াকাটা গেষ্ট হাউস, মোহনা, কুয়াকাটা ইন, বনানী প্যালেস, স্কাই প্যালেস, বিচ হ্যাবেন ও নিরঞ্জনা। কাজ চলছে থ্রি স্টার নির্মাণেরও। এসব হোটেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ৮শ’ থেকে ৩হাজার টাকা। ৪টি হোটেলেই কনফারেন্স রুম,খাবার হোটেলসহ যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে।
কুয়াকাটার শুটকি শিল্প
কুয়াকাটার শুটকি শিল্পের ইতিহাস প্রায় ২০ বছর আগের। এ সময় ব্যাপক লোডশেডিংয়ের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের বরফকলগুলো বন্ধ হয়ে যায় ক’দিনের জন্য। তখন বরফের অভাবে কুয়াকাটার জেলেরা তাদের মাছের পচন ঠেকাতে ইলিশ, পোয়া, রামসোস, রুপচাঁদাসহ বিভিন্ন মাছের শুটকি তৈরি করে। এভাবেই কুয়াকাটায় শুটকি শিল্পের শুরু। এরপর চট্টগাম থেকে ৪/৫ টি পরিবার কুয়াকাটায় এসে মাছ শুটকি করার কাজে যোগ দেয়।
কুয়াকাটার রুপচাঁদা, লইট্যা, পোয়া, বাইল্যা, বগ্নি, চিংড়ি, হাঙর, শাপলাপাতা, ছুড়ি ও রামসোস মাছের শুটকি চট্টগ্রাম হয়ে বিদেশে যায়। এছাড়া চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া সহ ইউরোপের বেশ ক’টি রাষ্ট্রে কুয়াকাটার শুটকি রফতানি হয়। কুয়াকাটার হাঙরের কান (শার্কপিন) দিয়ে তৈরি হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামী স্যুপ।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে লেবুর চরে অস্থায়ী ভাবে বাঁশ দিয়ে তৈর করা হয় শুটকির চাঙ।
![](files/September2015/September27/patuakhali_kuakata_pic_19_258770203.jpg)
এছাড়াও কুয়াকাটায় আছে প্রায় দুইশ বছরের পুরনো শাম্পান নৌকা, গঙ্গামতি চরের লাল কাকড়ার বিরল দৃশ্য, পাশেই নতুন করে গড়ে ওঠা বিশাল ডুবো চর। এখন পর্যন্ত কোন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের এটিম বুথ কুয়াকাটায় খোলা না হলেও ঢাকার মত বেশি স্পিডের থ্রিজি নেটওয়ার্ক সর্বদাই পাওয়া যায় কুয়াকাটায়।
পর্যটকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য এবছরই প্রথম চালু করা হয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ সেন্টার। আগের নৌ পুলিশের সঙ্গে ট্যুরিস্ট পুলিশ দিন রাত পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য টহল দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৫
পিসি