ঢাকা: বলা হয়, কাজের কোনো ছোট-বড় নেই। সব কাজই সমান গুরুত্ব বহন করে।
পাছে পরিচিতজনরা সব জেনে যায়, সে ভয়েই প্রকৃত নাম-ধাম গোপন করে অন্ন, বস্ত্র আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করে চলেন তারা। যদিও সে বাসস্থান হচ্ছে ফুটপাত।
বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ময়মনসিংহ লেন, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, আজিমপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তার ফুটপাতে চোখে পড়ে এসব ছিন্নমূল মানুষ। যারা সব হারিয়ে বা অভাবের তাড়নায় গ্রাম ছেড়ে এসেছেন রাজধানীতে। রাস্তার ধারে টুপরির মতো বিশেষ কায়দায় পলিথিন বা প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়ে মোড়ানো ঘরে বসবাস করেন। হ্যাঁ, ঘরই তো। নিজের জন্মমাটিতে যাদের স্থান নেই তাদের কাছে টুপরিগুলোই তো স্বর্গরাজ্য!
এখানে আশ্রয় নিয়েই ওরা ঘুমায়, রান্না করে, সোহাগ করে, ঝগড়া করে, সন্তান জন্ম দেয়। এখানেই তাদের সন্তান পায় খেলার মাঠ। তিন বেলা পেটপুরে অন্ন। তাচ্ছিল্যের জীবন যখন বাঁকা হাসি হাসে, তখন জীবনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আদরের ধনের বেড়ে ওঠার মাঝে জীবনের মানে খোঁজেন তারা।
কারওয়ান বাজারের পান্থকুঞ্জ সংলগ্ন ফুটপাতে গিয়ে দেখা গেলো, একদল বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। কাতুকুতু দিয়ে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে একটি মেয়ে। আর ছেলেটি মুখ ভার করে আছে। মায়ের হাতে বিস্কুটের প্যাকেট দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়লো ওরা। পাশেই এক প্রৌঢ়া নুন ভাত খাচ্ছেন। অন্যদিকে দলবেঁধে কিশোরী বধূরা একে অপরের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন। এতো কোলাহল, এতো ভিড়, এতো দুর্গন্ধের মাঝেও তারা কি সুন্দরভাবে একটি গ্রামকেই যেন ফুটিয়ে তুলেছেন।
কাছে ঘেঁষতে এক বয়স্ক নারী দেখে এগিয়ে এলেন। মনে হলো বেশকিছু তথ্যই পাওয়া যাবে তার কাছে। নাম-পরিচয় জানাতেই বলতে শুরু করলেন, ‘আমি কতা কইতে পাই না। কি থ্যুয়ে কি কমু ঠিক নাই। ওগরে (অন্যদের) কন, কি কবেন। ’ বুঝতে অসুবিধা হলো না বাড়ি তার জামালপুরে। বললাম, জামালপুর কোন থানায় বাড়ি? তাঁর উত্তর একটাই-‘আমি কতা কইতে পারি না। ’ নানাভাবে বোঝানোর পরও কোনো উত্তর দিলেন না তিনি। অগত্যা পাশ থেকে অন্য বয়স্ক নারীটি বললেন-মাদারগঞ্জ। তার নাম মালিহা বানু। মেয়ের সঙ্গে এখানে থাকেন।
এভাবে সবার কাছেই ব্যর্থ হতে হলো। সাংবাদিক পরিচয় জেনে কেউ কথা বললেন না। অবশেষে একজনকে পাওয়া গেল, নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলবেন। রাজি হওয়ায় একটু সহজ হলেন তিনি। জানালেন বাড়ি পঞ্চগড়। ফুটপাতে থাকেন দশ বছর হতে চললো। বাসা থেকে ডাস্টবিনে ময়লা ফেলার কাজ করেন। মাসে ছয় হাজার টাকা পান। এতেই তার সংসার চলে। ঘরে তার এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে খালার কাছে থেকে ক্লাস সেভেনে পড়ে পঞ্চগড়েই। ছেলেটি বয়স ছয় বছর। দীনতা না কাটলেও গ্রামের সেই অনাহারের দুর্বিষহ দিনগুলো আর নেই।
তিনি জানান, এই ফুটপাতে প্রায় ৩০টির মতো টুপরি ঘর। যার বাসিন্দারা একেক জন একেক জায়গার। এদের মধ্যে কেউ অন্যের বাসায়, কেউবা হোটেলে কাজ করেন। অনেকে আবার টোকাই। পুরুষদের কেউ রিকশা, কেউ ঠ্যালা গাড়ি চালান। কেউবা আবার দিনমজুরি করেন। সবারই গ্রামে আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। পত্রিকার সঙ্গে কথা বললে গ্রামের আত্মীয় জেনে যেতে পারেন। তাই তারা সাংবাদিক বা কোনো উন্নয়ন সহযোগী এলে পরিচয় দিতে চান না। কেননা, জানাজানি হয়ে গেলে কালে-ভদ্রে গ্রামে যাও যেতেন, তাও আর হবে না।
একই অবস্থা ময়মনসিংহ লেনের গর্ভবর্তী নারীটিরও। অনেক চেষ্টা করেও নাম জানা গেলো না তার। শুধু বললেন, ঝামেলা বাড়াইয়েন না।
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৫
ইইউডি/এএ