রাজবাড়ী (উড়াকান্দা) থেকে: ‘লেখে কী কইরবা, কতজন আসে লেখে নিয়ে গেল কিছুই তো অইলো না। আমাগারে কেউ কোনো সাহায্যে দিলো না।
এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন রাজবাড়ী জেলার বরাট ইউনিয়নের উড়াকান্দা গ্রামের সুখজান বিবি। তার বসত ভিটা নদী গর্ভে চলে গেছে। মাথা গোঁজার শেষ সম্ভল হারিয়ে পাগলপ্রায় এই নারী।
তার ভাষ্যমতে, ‘দিনে ক্যা ভাঙলে, রাতে ক্যানে নিলা না। রাতে নিলে তো ঘুমে থাকতাম ভাইসা যাতাম। এখন কনে যাবো, কার কাছে জায়গা পাবো। ছেলে-মেয়েদের কনে ঘুমাতে দেবো। ’
সম্প্রতি সরেজমিনে রাজবাড়ী জেলার বরাট ইউনিয়নের উড়াকান্দা গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় বেশির মানুষের বসত ভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মাথা গোঁজার জায়গাটুকু হারিয়ে অনিশ্চয়তা আর দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তারা।
যাদের ঘর নদী গর্ভে চলে গেছে, তাদের অনেকেই রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য অন্যের জমিতে টিনের চালা তৈরি করছেন।
১৮ সেপ্টেম্বর দিনের বেলা চোখের সামনেই সুখজান বিবির আশ্রয়ের জায়গা টুকু বিলীন হয়ে যায় পদ্মায়। তার মতো একই গ্রামের আরও তিনটি পরিবারের বসত-ভিটা কেড়ে নিয়েছে খরস্রোতা পদ্মা।
![](files/October2015/October03/2m_202333142.jpg)
তারা বলেছেন, ঈদের দিনটিও তাদের খোলা আকাশের নীচে বসে কাটাতে হয়েছে। কিন্তু কেউ এতটুকু সাহায্যের হাত বাড়োয়নি।
ক্ষোভ আর দুঃখ প্রকাশ করে নদী ভাঙনের শিকার মোছা. নাছিমা বেগম (৪৫) বলেন, ‘ভাঙার আগেও এমপি সাহেব আইসা দেইখ্যা যান। আমরা সবাই বলেছিলাম আমাদের বাঁচান। এমপি, ডিসি (জেলা প্রশাসক) বলেছিল তারা দেখবো। কই আর তো আইলো না। যদি বস্তা ফেলতো তাহলে ঘর গুলো আজ আর ভাঙতো না। ’
ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব রাজমিস্ত্রী মজিবর মোল্লা (৫০)। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে চরম কষ্টে দিনযাপন করছেন তিনি।
ঘর-বাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর অন্যের বাড়ির বারান্দায় বেশ ক’দিন ধরে রাতযাপন করেছেন। এখন বাধ্য হয়ে আরেক প্রতিবেশীর উঠোনে টিনের চালা তুলছেন তিনি।
বলছিলেন, ‘আজ চারদিন হলো একমাত্র সম্পদ বাড়ি ভিটা সেটাও পদ্মায় চলে গেছে। আজ পর্যন্ত কেউ কোনো খোঁজও নিল না। এমপি, চেয়ারম্যান কতজন আছে। এরমধ্যে চেয়ারম্যানের দেওয়া ১০ কেজি চাল ছাড়া কিছু পাইনি। ’
![](files/October2015/October03/Urakandha_3_banglanews24_817080486.jpg)
‘এই চাল দিয়া কী করবো? আমরা কারো কাছে ভিক্ষা চাই না। নদীর পাড়টা বাইন্ধা দিলে কারো কিছু দেওয়া লাগতো না। আমরা কাজ কইরা খাইতে চাই,’ বলেন মজিবর মোল্লা।
এরমধ্যে ভিটে হারাদের দলে যুক্ত হয়েছেন একই গ্রামের নায়েব আলী ও আব্বাস সরদার। তবে ভাঙনের কাছে তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের পাওয়া যায়নি।
জানালেন, থাকার জায়গা না থাকায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিভিন্ন এলাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, দু’একদিনের মধ্যে চারটি পরিবারের মোট ১২টি ঘর নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। সবগুলো ঘরই ছিলো টিনের।
এমনকি নদী থেকে কয়েক গজ দূরে উড়াকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়য়টিও ঝুঁকিতে রয়েছে। যেকোনো সময় নদী গর্ভে চলে যেতে পারে এ স্কুলটিও।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহাদী হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ‘নদী ভাঙনের কারণে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী কমে গেছে। অনেকেই ভয়ে আসতে চায় না। স্কুলে আগে প্রায় চারশ’র মতো ছাত্র-ছাত্রী ছিলো। এখন তা ২৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে।
![](files/October2015/October03/Inner_urakandha_754587534.jpg)
তিনি জানান, দুই-তিন মাস আগে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পক্ষ থেকে স্কুলের পেছনে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে, তাই এখন বেশি ভাঙছে না। স্থায়ী সমাধানের জন্য নদীর তীরে আরসি ব্লক দিয়ে বাঁধ দিতে হবে।
বরাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী সামসুদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, শুধু এবছর পদ্মা আমার ইউনিয়নের ১০ একর (১ একর=১০০ শতাংশ) ভূমি কেড়ে নিয়েছে। গত বছর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় প্রায় ৩০একর।
‘প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ভাঙন ঠেকাতে সিসি ব্লক (খোয়া, বালি, সিমেন্টের তৈরি) দিয়ে নদীর পাড় বাঁধা যাচ্ছে না,’ বলেন তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজবাড়ীর বরাট ও মিজানপুর ইউনিয়ন নদী ভাঙনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। আমরা তাদের বিষয়টি সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য পাউবোকে বলেছি।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৫
এসএম/এমএ