ঢাকা, শনিবার, ২৫ মাঘ ১৪৩১, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

বর্জ্যে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে চরকালিবাড়ি

এম.আব্দুল্ল‍াহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৫
বর্জ্যে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে চরকালিবাড়ি ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চরকালিবাড়ি (ময়মনসিংহ) ঘুরে : অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা আবর্জনার স্তূপে ময়মনসিংহের শহরতলী শম্ভুগঞ্জের চরকালিবাড়ি এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ চলছে। দম বন্ধ করা অবস্থায় স্থানীয় জনজীবনে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে।



পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ কবলিত ময়লাকান্দার প্রায় ৫ হাজার মানুষ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। মশা-মাছির উপদ্রুব আর অসহনীয় দুর্গন্ধে এলাকায় বসবাস করা যেমন কষ্টকর, তেমনি সেখানে যাতায়াতও কঠিন।

দুর্গন্ধে ভারী বাতাসের কারণে শ্বাসকষ্ট, জন্ডিস, ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকছেন তারা। বিশেষ করে এলাকার শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধরা রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। এখানে বিপন্ন হয়ে উঠেছে জনজীবন।

পরিবেশের এমন দূষণ নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ তথ্য স্থানীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে নেই বলে স্বীকার করেন ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. ইউসুফ আলী। এ গ্রামে কোনো পরিদর্শক দলও এখন পর্যন্ত যায়নি বলেও জানান তিনি।

তবে তিনি বলেন, ‘সবার কাছ থেকেই শুনেছি ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে স্থানীয় জনসাধারণ একেবারেই অতিষ্ঠ। সেখানে মার‍াত্মক পরিবেশ দূষণ চলছে। এতে জীববৈচিত্র্যও মারাত্মক হুমকির মধ্যে আছে। এ দূষণ রোধ করার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছি।  

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ময়লাকান্দায় ফেলা এসব ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনা থেকে হাসপাতাল-ক্লিনিকের আবর্জনাকে আলাদা করা হয়নি। স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এসব আবর্জনা আলাদা না করে এখানে ইচ্ছামতো ফেলা হয়। নিক্ষিপ্ত ময়লা-আবর্জনার তালিকায় রয়েছে ব্যবহৃত সুঁচ, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পুঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, অবৈধ নবজাতক, কুকুর, ওষুধের শিশিসহ বিভিন্ন চিকিৎসাজাত বর্জ্য।  

চরকালিবাড়ি মধ্যপাড়া গ্রামের স্থানীয় চা দোকানি সোহেল রানা (২৮) বলেন, ‘পূব বাইতে বাতাস আইলে একবারে শেষ। দম বন্ধ অইয়া যায়। আমগর গ্রামের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ শ্বাস-কষ্টে ভুগতাছে। ’

এ এলাকার গৃহবধূ নাছিমা বেগম (৪৫) বলেন, ‘ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে ঘরে ঘরে অসুখ-বিসুখ লাইগ্যাই রইছে। মানুষজন ডায়রিয়া-কলেরা ও চর্মরোগে ভুগতাছে। কিন্তু কেউ তো আমগর কষ্ট বুঝে না। ’

বাসের অযোগ্য হয়ে উঠা ময়লাকান্দা’র স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে উদ্বিগ্ন ময়মনসিংহ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এ বিষয়ে ময়মনসিংহের ডেপুটি সিভিল সার্জন শাহীন সুলতানা বলেন, ওই গ্রামে দূষিত বাতাস নেয়ার ফলে সেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সেখানে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস বি, জন্ডিস, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। ’

রোদ-বৃষ্টিতে এখানে দুর্গন্ধের মাত্রা আরো প্রকট হয়ে উঠে। প্রতিদিন এখানে ফেলা প্রায় ১২৫ মেট্রিক টন ময়লা-আর্বজনা ধ্বংস করা হচ্ছে না। ময়লাকান্দার পাশেই রয়েছে ব্র্যাকের ট্রেনিং সেন্টারসহ অনেক আবাসিক এলাকা। এ ডাম্পিং স্পেশনে দুর্গন্ধ ও দুষণমুক্ত করতে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে নিয়মিত ব্লিচিং পাউডার ছিটানোর উপরও গুরুত্বারোপ করেন স্থানীয়রা।

চর কালিবাড়ি গ্রামের আলামিন ও বাচ্চু মন্ডল বলেন, এ দুর্গন্ধময় পরিবেশ দূর করতে প্রতিদিন নিয়মিত ব্লিচিং পাউডার ছিটানো দরকার। পৌর কর্তৃপক্ষ এটা তদারকি করলে স্থানীয় জনসাধারণ ও পথচারীরা দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা পেতো। ’

তবে ময়মনসিংহ পৌরসভার সেনেটারি ইন্সপেক্টর দীপক মজুমদার দাবি করেন, তারা দুর্গন্ধ রোধে নিয়মিত ব্লিচিং পাউডার ছিটাচ্ছেন। কিন্তু এতে কোন কাজ হচ্ছে না। এর বিকল্প নিয়ে তারা চিন্তা ভাবনা করছেন।

এদিকে, ময়লা-আবর্জনার পানিতে মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে মহাসড়কের প্রায় সোয়া কিলোমিটার রাস্তা। এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম আল মামুন বলেন, ময়লা-আবর্জনা অনেক সময় মহাসড়কের উপরে ফেলার কারণে সড়ক নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হবে।

এ ময়লা আবর্জনার কারণে শুধু সড়ক নয়, ভয়াবহ পরিণতি নেমে এসেছে আশপাশের কৃষি জমিতেও। স্থানীয়দের মতে, অন্তত ১০ একর কৃষি জমিতে বোরো আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে সংশ্লিষ্ট কৃষক পরিবারগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন।

মহাসড়কের পাশেই ময়লা-আবর্জনার পানির কারণে এ গ্রামের মো: আব্দুস সালাম নিজের ৫ কাঠা জমিতে বোরো আবাদ করতে পারেননি। আগে তিনি জমিতে বছরে তিন ফসল করতেন। এখন শুধু ইরি ও সরিষা চাষ করেন। বোরো মৌসুমে চাষবাস করতে না পারায় সালাম এখন বেকার। এখন জমি বিক্রি করে অন্য ব্যবসা করবেন বলে চিন্তাভাবনা করছেন।

একই রকম সমস্যার মুখে পড়েছেন স্থানীয় কৃষক জয়নুদ্দিন (৪২)। তারও ১০ থেকে ১২ কাঠা জমিতে বোরো চাষ করতে পারেননি। তাদের ক্ষোভ, ‘ময়লার পানির কারণে আমরা চাষবাস করতে পারি না। যেই জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে উদ্যোগ নেব, তারাই না কী ভাতা পায়। এ লেইগ্যা আমরার দুর্গতিও দূর অইবো না। ’ 

স্থানীয়রা জানান, আগে চরকালিবাড়ি এলাকায় কৃষি জমির দাম ছিল প্রায় আড়াই লাখ টাকা শতাংশ। এখন ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ের কারণে জমির দাম মাত্র দেড় লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

স্থানীয় মাইক্রো-প্রাইভেটকার গ্যারেজের মালিক মো: আলামিন বলেন, ‘আগে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা শতাংশে জমি বিক্রি হইতো। অহন দাম কইম্যা ১ থেকে দেড় লাখ টাকা হইছে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।