ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মাঘ ১৪৩১, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

মাটির ঘরের হাসিনা দৌলার বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৫
মাটির ঘরের হাসিনা দৌলার বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: তিনি থাকেন মাটির এক ছোট্ট ঘরে। কবরের কাছাকাছি বসবাস করছেন বলে দাবি করেন নিজেই।

অথচ একশ’ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তিনি সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক হাসিনা দৌলা।

বিভিন্ন প্রকল্পের ভুয়া বিল দেখিয়ে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে হাসিনা দৌলাকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগামী ২১ অক্টোবর বুধবার সকালে তাকে সশরীরে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে সেখানে।

ছোট্ট মাটির কুটিরে হাসিনা দৌলার বসবাস আর শত কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগের অসম্ভব বৈপরিত্য জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। তাহলে কোথায় গেলো একশ’ কোটি টাকা! কেনইবা মাটির ঘরে থেকেও তার বিরুদ্ধে উঠেছে শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ?

এসব প্রশ্নের উত্তর পেতেই বাংলানিউজ মুখোমুখী হয় হাসিনা দৌলার।

সাভারের কুটুরিয়া গ্রামে আড়াই বিঘা জমিতে হরেক রকম গাছ গাছালি। বেশির ভাগই অকির্ড। এর মাঝে ছোট্ট মাটির ঘর। সেই ঘরের পাশে আরেকটি টিনের ঘর।

সেখানে বেশকিছু চেয়ারপাতা। মাথার ওপর ঝুলছে দলীয় প্রতীক নৌকার অসংখ্য রেপ্লিকা। নির্জনতা ভাঙ্গা পাখির ডাক মনে করিয়ে দেয় ভিন্ন পরিবেশের কথা। ঘুঘুর একটানা ডাক চমকে দেয় অতিথিদের। ১৯৭৭ সাল থেকে এই পরিবেশেই আছেন হাসিনা দৌলা।

ছিলেন খ্যাতনামা মাইক্রো ইলেকট্রনিক্সের স্বত্ত্বাধিকারী। জামালপুরের এই শিল্প উদ্যোক্তা সাভারে বসবাসের সুবাদেই ১৯৯৪ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।

একদিকে ব্যবসায় পতন আর তার বিপরীতে রাজনীতিতে দ্রুত উত্থান ঘটে তার। শিল্পপতি পরিচয় থেকে হয়ে যান সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি। সেই রাজনীতির স্রোতে ভেসে হয়েছেন ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক। কিন্তু নাটকের সেখানেই শেষ নয়।

ঢাকা জেলা পরিষদের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জেলা পরিষদের উপসহকারী প্রকৌশলী, বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ ৭০ জনের বিরুদ্ধে গত ১২ অক্টোবর ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, আশুলিয়া, সাভার, কেরানীগঞ্জ, ধামরাই এবং রাজধানীর কোতোয়ালি, গুলশান ও তেজগাঁও থানায় ১৫টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

আগামী ২১ অক্টোবর হাসিনা দৌলাকে তলব করা হয়েছে দুদুকে। প্রধান অভিযোগই হচ্ছে, বিভিন্ন প্রকল্পের ভুয়া বিল দেখিয়ে শত কোটি টাকা আত্মসাত। তার মেয়াদের মধ্যে ২০১১-১২, ২০১২-১৩, এবং ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এই দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে বলে বেরিয়ে আসে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে।

২০১২-১৩ সালে ধামরাইয়ে একটি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে হাসিনা দৌলার কথিত পিএস মাহবুবুর রহমান (মনি) বিভিন্ন সময়ে মোট ১ হাজার ৫০টি চেকের মাধ্যমে ৯ কোটি ৭৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা তুলেছেন। কোনো অনুমোদন ছাড়াই তোলা হয় এই অর্থ ।

একই বছর নবাবগঞ্জে যন্ত্রাইল কবরস্থানের উন্নয়নে একটি প্রকল্পে কাজ না করেই ৭৯ শতাংশ টাকা পরিশোধ করা হয়। যাতে দুর্নীতি হয়েছে বলে জোর সন্দেহ দুদকের।

নবাবগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব সংস্কার এবং নবাবগঞ্জ মার্কেট আধুনিকায়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও কাজ শেষ হওয়ার আগে বিল পরিশোধসহ প্রায় একশ’ কোটি টাকার দুর্নীতির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই হাসিনা দৌলাকে দপ্তরে ডেকেছে দুদক।

এসব বিষয়ে আলাপচারিতায় হাসিনা দৌলার জবাব-
‘আমি কি ফকির? আমাকে কেন দুর্নীতি করতে হবে। এই রাজনীতির জন্যেই আমি খুইয়েছি আমার মাইক্রো ইলেকট্রনিক্স। হারিয়েছি আমার সংসার, সন্তান, সবকিছু। দুর্নীতিই যদি করবো, তবে মাটির ঘরে কেন। আমি তো থাকতাম আলিশান বাড়িতে। অথচ আমাকে আরো একটি জমি বিক্রি করতে হচ্ছে।

তাহলে কি বলতে চাইছেন, দুর্নীতি হয়নি?
‘হয়েছে। তবে সেটা ক্ষুদ্র প্রকল্পগুলোতে। বড় কোন প্রকল্পে কোন নয়ছয় হয়নি। যা হয়েছে দুই লাখ টাকার মতো ছোট ছোট প্রকল্পে- সহজ স্বীকারোক্তি হাসিনা দৌলার।

প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে তাহলে তো আপনার ওপরই এর দায় বর্তায়।

এমন প্রশ্নের মুখে হাসিনা বলেন, আমি কেন দায় নেবো? আমি তো দুর্নীতি করিনি। যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। ব্যাংকগুলো কেন এভাবে টাকা ছাড় করলো। ওরাও তো ফেঁসে যাচ্ছে। অনেকেই দুর্নীতি করা অর্থ এখন ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমি হাসিনা দৌলা। যদি দুর্নীতিই করতাম তবে আমাকে তো সরিয়ে দিতো মন্ত্রণালয়। আর যিনি আমাকে জেলা পরিষদ প্রশাসকের পদে বসিয়েছেন সেই প্রধানমন্ত্রীও তো আমাকে সরিয়ে দিতেন।

তারা জানেন, আমি কেমন। থাকি মাটির ঘরে। কবরের কাছাকাছি। পয়সার লোভ ছিলো না কোনদিন। দুই হাতে বিলিয়েছি।

তবে হ্যাঁ, পত্র পত্রিকায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে না লিখলে তো কেউ পড়ে না। টিভি কেউ দেখে না। অনেকেই আমাকে বলেছে, প্রতিবাদ দিতে। দেইনি। কাটতি বাড়াতেই আমাকে নিয়ে এতো মাতামাতি হচ্ছে।

এসব দেখে মন খারাপ হয়েছে। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেছি, তবে ভেঙ্গে পড়িনি।

নোটিশ কি পেয়েছেন? প্রস্তুতি কতটুকু?
তিনি বলেন, কিসের নোটিশ। কোন নোটিশ পাইনি। প্রস্তুতির কি আছে। আমাকে ডাকলে যাবো।

ফাইলপত্রের প্রস্তুতি?
ওসব নিয়ে যেতে হবে- এমন কিছু তো শুনিনি। চেহারা দেখতে চেয়েছে। গিয়ে চেহারা দেখিয়ে আসবো।

তাহলে এত অভিযোগের কারণ কি?
সব‍াই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা এই পদে বসতে চান। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাভারের অনেকে। তবে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, আমি একটি পয়সাও হারাম উপার্জন করিনি। প্রমাণিত হবে আমার সততা- বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন আওয়ামী লীগের আলোচিত নেত্রী হাসিনা দৌলা।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।