ঢাকা: দেশের সুবিধাবঞ্চিত ও অভিভাবকহীন অনাথ শিশুদের আশ্রয়, খাইয়ে, পড়িয়ে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে গিয়ে মানবপাচার মামলায় আসামি হলেন তারা।
এরপর রিমান্ড, রিমান্ডে শেষে কারাগারে ও ৩৭ দিন কারাবাসের পর অতঃপর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ‘অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’র চার কর্মকর্তা।
তবে আদালতের বারান্দায় বারান্দায় পথশিশুদের কান্না, আইনজীবীদের যুক্তি বিচারকের মন গলাতে পারেনি। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে মামলাটি করা হয়েছিল মর্মে পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে তাদের জামিন মঞ্জুর করেছেন বিচারক।
জামিনপ্রাপ্তরা হলেন- প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান, হাসিবুল হাসান সবুজ, জাকিয়া সুলতানা ও ফিরোজ আলম খান শুভ।
মানব সেবা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে ৩৭দিন জেলের ঘানি টেনেছেন তারা। রিমান্ডের মুখোমুখি হয়েছিলেন ২ দিন।
রিমান্ড শুনানিতে ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জাকির হোসেন টিপু মামলার প্রধান আসামি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আরিফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন।
ম্যাজিস্ট্রেট জানতে চান, কীভাবে তারা বাচ্চাদের সংগ্রহ করতেন? জবাবে আরিফুর বলেন, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যেমন সদরঘাট, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের স্বেচ্ছাসেবকরা কমপক্ষে ২ থেকে ৩ মাস ছিন্নমূল বাচ্চাদের পর্যবেক্ষণ করে। একই বাচ্চা দিনের পর দিন এক স্থানে থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হলে তাদের অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের আশ্রয়ে থাকার প্রস্তাব দেওয়া হতো। যারা আগ্রহী হতো শুধুমাত্র সেসব বাচ্চাদেরই শেল্টার হোমে নিয়ে সেবা দিতেন তারা।
‘কথিত’ উদ্ধার হওয়া শিশুর অভিভাবকদের সঙ্গে আদালতের বারান্দায় কথা বললে বেরিয়ে আসে তরুণ-যুবাদের নিঃস্বার্থ সমাজ সেবার কথা। উঠে আসে তাদের ভাগ্য বিড়ম্বনার নানা কথাও।
সিএমএম আদালতে রিমান্ড মঞ্জুরের পর স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে কাজ করা প্রায় ৭/৮ জন তরুণী কেঁদেছেন আদালতের বারান্দায়।
ভৈরব থেকে ছুটে আসা সুব্রত সাহা নামে এক কলেজ পড়ুয়া জানালেন, তারা সিগারেট খাওয়ার টাকা জমিয়ে প্রতি মাসে দেড়শ’ টাকা করে এখানে দেন। এরকম অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দান থেকেই এসব অসহায় শিশুদের সেবা করতেন তারা।
সিএমএম আদালতে জামিন না হলে তাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেন। তিনি গত ১৩ অক্টোবর ওই আদালতের বিচারক কামরুল হোসেন মোল্লাকে সব বিষয় জানিয়ে শুনানি করেন।
কিন্তু বিচারককে সন্তুষ্ট করতে না পারায় তাদের জামিন হয়নি। জামিন নামঞ্জুরের খবরে সেদিন মহানগর দায়রা জজ আদালতের বারান্দায় কান্নায় ভেঙে পড়েন পথশিশুরা।
জামিন হবে, তাদের প্রিয় স্যারদের স্বাগত জানাবে এ আশায় ফাউন্ডেশনের নিজস্ব ইউনিফর্ম লাল পোশাক পরে আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় করেছিল তারা। কিন্তু তাদের সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি।
অবশেষে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রামপুরা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোজাম্মেল হক সোমবার (১৯ অক্টোবর) তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
প্রতিবেদনে এসআই মোজাম্মেল উল্লেখ করেন, অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন একটি অরাজনৈতিক, অলাভজনক, বেসরকারী দাতব্য প্রতিষ্ঠান তা তদন্তকালে উঠে আসে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অভিভাবকহীন শিশুদের এখানে এনে রাখতেন এই সংগঠনের কর্মকর্তারা।
অনেক দানশীল প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি চালানো হয়।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, এসব শিশুর উন্নত জীবনের পাশাপাশি শিক্ষা, বিনোদন ও স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্য তাদের দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে খেলার ছলে ‘কাগজের ঠোঙ্গা’ বানানো হয়।
মোবাইল ফোনে শিশুরা তাদের অভিভাবকদের সঙ্গেও কথা বলতে পারতো। গত ১ বছরে পাচারের জন্য শিশুদের অন্যত্র সরানো হয়েছিল এমন কোনো তথ্যের সত্যতা তদন্তে পাওয়া যায়নি।
মামলার ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বললে তারা অকপটে অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের ভালো কাজের কথা স্বীকার করেছেন মর্মেও জানানো হয় প্রতিবেদনে।
বাদী জনৈক মনির হোসেন ভুল মামলা করেছেন। তিনি ভুল তথ্য দিয়ে অভিযোগ দায়ের করলেও তা যাচাই বাচাই না করে মানব হিতৈষী এ মানুষগুলোর বিরুদ্ধে থানা পুলিশের মামলা নেওয়া কতটা যৌক্তিক - এ প্রশ্ন আদালতের এখন সচেতন আইনজীবী ও সাধারণ মানুষেরও।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৫
এমআই/এমএ