ঢাকা: ঘটনা এক: রাত ১ টার কাছাকাছি। রাজধানীর পল্টন থানায় আবুল খায়ের টাওয়ারের নিচে হোলসেল মার্কেটে ডাকাতির মামলায় আসামি ধরতে পুলিশের অভিযান চলছিলো নারায়ণগঞ্জে।
আক্ষেপের সুরে বাংলানিউজকে সে কাহিনী বলছিলেন মোরশেদ আলম। তিনি বলেন, সামনে ডাকাত দলের গাড়িটি ছিলো আধুনিক আর আমাদেরটি পুরোনো লক্কর ঝক্কর। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। আমাদের গাড়িটি বন্ধ হয়ে গেলো মাঝপথে। আর আধুনিক গাড়িতে নাকের ডগা দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেলো ডাকাত দল।
ঘটনা দুই: গভীর রাতে ফোন বেজে উঠলো কাফরুল থানার। কোনও এক বিপদগ্রস্তের বিপদা বড়ই ছিলো তাই দ্রুত ফোর্স নিয়ে রওনা দেন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহিদুল ইসলাম। পথিমধ্যে নষ্ট হয়ে যায় গাড়িটি। গভীর রাতে আশেপাশেও কোন মেকার নেই। অগত্যা, অভিযান থামিয়ে নষ্ট গাড়িটি নিয়ে যেতে হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। এভাবেই সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ ব্যর্থ হলো কাঙ্খিত সেবা দিতে।
ঘটনা তিন: টহল পুলিশের ডিউটি সকাল ৮ থেকে রাত ৮। রাজধানীর উত্তরা (পশ্চিম) থানা থেকে সকাল বেলা টহল দিতে বের হয়েই নষ্ট হয়ে গেলো ডিউটির গাড়ি। একটি সিএনজি অটোরিক্সা পাকরাও করে টহল শুরু করলেন এস আই বখতিয়ার ইসলাম। । কিছুক্ষণ পর সিএনজি চালক হাতে-পায়ে ধরে নিজের গাড়ি নিয়ে কেটে পড়লেন। গাড়ি ছাড়া কি পুলিশের পক্ষে টহল দেওয়া সম্ভব? ফলে যা হওয়ার তাই হলো। আক্ষেপের সুরই ঝরছিলো বখতিয়ার আলমের কণ্ঠে।
রাজধানীর থানাগুলোতে কর্মরত বেশ কয়েকজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপ-পরিদর্শক, পুলিশ কনস্টেবলদের সাথে কথা বলে স্পষ্টই ধারণা পাওয়া গেল, সবগুলো থানার চিত্রই কমবেশি একই রকম।
তারা জানালেন, ডিউটির জন্য তাদের গাড়ি সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আর যেগুলোও রয়েছে তার অবস্থা খুবই নিম্নমানের। ফলে আসামি আটক করা, দ্রুতগতিতে ঘটনাস্থলে পৌছানো, যেকোন অভিযান সঠিকভাবে পরিচালনা করাসহ সব ধরনের কাজ ব্যহত হচ্ছে। এতে করে সার্বিকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে পুলিশি কর্মকাণ্ড।
পুলিশের খতিয়ানে দেখা গেছে রমনা বিভাগে পুলিশের জন্য রয়েছে মোট ১০ টি গাড়ি আর রমনা থানার রয়েছে ৯টি গাড়ি, যার মধ্যে একটি মাত্র মাইক্রোবাস, বাকি ৮টিই পিকআপ ভ্যান। আর সেগুলোর ব্র্যান্ড ইসুজু, মিতসুবিসি, কেয়া, ইমা ধরনের। মাইক্রোবাসটি টয়োটার লাইটেস ব্র্যান্ড। আর একটি নিশান ডাবল কেবিন পিকআপ রয়েছে এই থানার।
শাহবাগ থানায় রয়েছে ছয়টি পিকআপ তার মধ্যে একটি নিশান ডাবল কেবিন গাড়ি। এমন করে ধানমন্ডি থানায় ৫টি, হাজারীবাগ থানায় ৩টি, নিউমার্কেট থানায় ৪টি, কলাবাগানে ৪টি, তেজগাঁও থানায় ৭টি, গুলশানে ৯টি, মোহাম্মদপুরে ৭টি, মিরপুর থানায় ৪টি, কাফরুলে ৫টি গাড়ি রয়েছে। মোট হিসেবে রাজধানীর ৪৯টি থানা ও ৭টি বিভাগে মোট গাড়ি রয়েছে ২৩৫টি। বিভাগ ভিত্তিতে মতিঝিল বিভাগে ৩৩ টি, রমনা বিভাগে ৩১টি, তেজগাঁও বিভাগে ৩০ টি, মিরপুর বিভাগে ২৭ টি, উত্তরা বিভাগে ৩০ টি, গুলশান বিভাগে ৩২ টি, লালবাগ বিভাগে ২১টি এবং ওয়ারি বিভাগে ৩১ টি গাড়ি রয়েছে।
রাজধানীর রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি) মো. মশিউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের থানায় যেসব গাড়ি রয়েছে সেগুলোর অবস্থা ভালো না। গাড়ি খারাপ থাকার ফলে আমাদের সেবার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পল্টন মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোরশেদ আলম জানালেন, এ থানায় গাড়ির সংখ্যা ৫টি। যার সবগুলোর অবস্থায় সোচনীয়।
তিনি বলেন, এখনকার ছিনতাইকারীরা লেটেস্ট মডেলের গাড়ি ব্যবহার করে। আমাদের ব্যবহৃত গাড়ি দিয়ে তাদেরকে আটক করতে বেশ বেগ পেতে হয়। তাছাড়া গাড়ির মান ভালো না হলে আমাদেরকে অনেক মিশনে গিয়েও স্রেফ বসে থাকতে হয়।
উত্তরা পশ্চিম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বখতিয়ার ইসলাম জানালেন তাদের গাড়ি রয়েছে ৬টি। আর সেগুলোর মধ্যে দুই-তিনটি প্রায়শঃই বিকল থাকে। তিনি বলেন, গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়া নিত্যদিনের চিত্র। ঠিক করার জন্য ৩ থেকে ৪ দিন লেগে যায়। আবার ঠিক করা হলে, কয়েকদিন পর আবারো সমস্যা দেখা দেয়।
বখতিয়ার জানালেন অন্য একটি সমস্যার কথাও। থানা এলাকায় গাড়ি নষ্ট হলে রেকার দিয়ে গাড়ি টেনে রাজারবাগ নিয়ে যেতে খরচ পরে প্রায় ২ হাজার টাকা। এটাও থানাগুলোর জন্য একটা বাড়তি চাপ।
উন্নতমানের গাড়ি যদি থানায় দেওয়া হলে থানার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে যাবে, বলেই দৃঢ় বিশ্বাস বখতিয়ারের।
মিরপুর কাফরুল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহিদুল ইসলাম জানান, তাদের থানায় ৫টি গাড়ি থাকার কথা থাকলেও সেখানে বর্তমানে গাড়ি রয়েছে ২টি। তাও দুদিন পর পর নষ্ট হয়ে যায়। রাজারবাগে গাড়ি জমা দিলে ৩ থেকে ৪ দিন পর গাড়ি ফেরত পাওয়া যায়।
ঢাকা মেট্রপলিট্রন পুলিশের উপ-কমিশনার (পরিবহন শাখা) কুদ্দুস আমিন বাংলানিউজকে বলেন, শুধু রাজধানীতে নয় সারাদেশের প্রতিটি থানায়ই গাড়ির সংকট রয়েছে। এছাড়াও যেসব গাড়ি বর্তমানে থানায় রয়েছে সেগুলোর বয়স প্রায় ১০ বছর। ফলে একবার নষ্ট হলে এগুলো সারাতে বেশ সময় লেগে যায়।
মন্ত্রণালয়ে গাড়ির সংকটের বিষয়টি জানানো হয়েছে, সরকার চেষ্টা করছে এ সংকট পূরণের জন্য, বলেন কুদ্দুস আমিন।
মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য পুলিশের প্রথম মাধ্যম হচ্ছে গাড়ি। অথচ এভাবে লক্করঝক্কর গাড়ি নিয়ে পুলিশকে প্রতিদিনই ছুটতে হচ্ছে নিত্যনতুন অপরাধমূলক ঘটনা, অভিনব অপরাধ কিংবা কৌশলী অপরাধীদের পেছনে। যা থেকে সাফল্য কতটুকু আসবে সে প্রশ্ন অভিজ্ঞ মহলের।
বাংলাদেশ সময় ০৮০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৫
জেডএফ/এমএমকে