ঢাকা: আদর্শ লিপি পড়া শিশুদের প্রথম শেখা, চেনা, জানা পশুটির নাম ঐরাবত। বইয়ের এক কোণে বিশালদেহী প্রাণীটির হাঁটার ছবি।
ঐরাবত চেনা হয় আমাদের। আর ইংরেজি ‘ই’ বর্ণমালা দিয়ে শেখা শব্দটিও ‘এগ’ এর চাইতে ‘এলিফেন্ট’ই হয়ে থাকে বেশি!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু ফরিদ ফারাবি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি ছড়া লেখেন, ভ্রমণ করেন। লিখেন ভ্রমণ কাহিনীও। ব্যাক্তিগতভাবে আমি তার লেখার ভক্তও।
গত ১৮ অক্টোবর (রোববার) জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে স্থানীয় গ্রামবাসী এক পৈশাচিক রূপ দেখিয়েছেন। দু’টি বন্য হাতিকে বৈদ্যুতিক তারের খুঁটি দিয়ে ফাঁদ পেতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এভাবে ঐরাবত’কে হত্যার ঘটনায় বেশ ক্ষিপ্ত ফরিদ ফারাবি। তিনি তার ফেসবুক টাইম লাইনে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘লোকালয়ে আসার অজুহাতে বাঘ-হাতির মতো সব বন্য প্রাণীকে বিলুপ্ত করে চলেছি আমরা বহুদিন ধরেই। বন্য প্রাণী শখ করে লোকালয়ে আসে না। তাদের আবাসন নষ্ট করে, খাদ্যের যোগান নষ্ট করে আমরা তাদের লোকালয়ে আসতে বাধ্য করেছি। তাই এর দায় শুধুই আমরা মানুষের। পৃথিবীর সকল প্রাণীকে এভাবে হত্যা করে একদিন শুধু মানুষই হবে এর একমাত্র বাসিন্দা। যদিও ইকোলজিক্যাল ভারসাম্য না থাকলে মানুষ নিজেও টিকে থাকতে পারবেনা। ’
তিনি লিখেছেন, ‘তাহলে উপায়! উপায় হচ্ছে বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যের পর পুলিশের উপস্থিতির মতো দৃশ্য না ঘটিয়ে আগেই প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। বন্য হাতির লোকালয়ে চলে আসার ঘটনা নতুন কিছু না। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতেও কিছুদিন আগে এধরনের ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজার বান্দরবানে এসব নিয়ে অনেক মিথ'ও প্রচলিত আছে।
প্রশাসন চাইলে ঘটনার পর তদন্তের মতো নাটক না করে গ্রামবাসীকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে বন্য প্রাণীগুলোকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারে। শুধু মানুষ না, সব প্রাণীর জন্য একটা বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে উঠুক। সচেতন হোক সবাই। ’
বন্ধুবর ফারাবির লেখাটি আমার মনের রক্তক্ষরণের মতোই। টানা ১০ ঘণ্টা ভ্রমণের পর শরীর এখন বেশ ক্লান্ত। ক্লান্ত ঠোঁটে বিড় বিড় করে আওরাতে থাকি, ‘ঐ’তে ঐরাবত, ঐরাবত আমরা ফেলছি মেরে...’।
এদিকে এ ফাঁদ পেতে হাতি হত্যার ঘটনায় স্থানীয় থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটিও।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা জেনারেটরের সাহায্যে বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে আটকে ২টি হাতি হত্যা করে। পরে হাতির দাঁত, শুঁড় ও কান কেটে নিয়ে যান তারা। বর্বরতার সব রূপই দেখিয়েছি হাতিগুলোর সঙ্গে আমরা মানুষেরা।
এরপর হাসতে হাসতে অনেকে আবার রক্তমাখা বিশালকার ঐরাবতের ছবিও তুলেছি। কাটা শুঁড়ের স্থান দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল, মোবাইলে সেই ছবি ধারণ করতে ভিড় করেছি, গায়ে গায়ে ধাক্কা খেয়েছি। ফাদেঁ ফেলে প্রাণী খুন করে বাড়ি ফিরেছি।
শিশু বয়স থেকেই হাতির প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল। টারজান যখন হাতির পিঠে চড়ে বেড়াতো বা টারজানকে উদ্ধার করতে ছুটে আসতো হাতি, তাকে সত্যিকারের বন্ধু মনে হতো।
যোগাযোগ করা হলে ময়মনসিংহের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গোবিন্দ রায় বলেন, জেনারেটরের বিদ্যুতের মাধ্যমে ফাঁদ পেতে হাতি দু’টিকে মারা হয়েছে। হাতি দু’টি মারা যাওয়ার পর কে বা কারা দাঁত, শুঁড় ও কান কেটে নিয়ে গেছে তারা।
জানা যায়, বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা নিয়ে সর্বশেষ জরিপ হয় ২০০৪ সালে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের আইইউসিএন'এর ওই জরিপে, বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা ছিল ২২৭ থেকে ২৪০ এর মধ্যে৷
আইউসিএন জানিয়েছে, মানুষের সংখ্যা বাড়ায় দিন দিন বনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে৷ আর এটাই হাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি৷ কারণ এর ফলে বাসস্থানের পাশাপাশি খাবার সংকটেও পড়ছে হাতিরা৷
এছাড়াও জনসংখ্যা বাড়ার কারণে এখন অনেক মানুষ বনের খুব কাছে বসতি স্থাপন করছে৷ ফলে প্রায়ই দেখা যায় বন্য হাতিরা মানুষের বসতি এলাকায় ঢুকে পড়ছে৷
হাতির সঙ্গে স্থানীয়দের একটি সংঘাত তৈরি হচ্ছে! ফলে মারা যাচ্ছে মানুষ, কখনও প্রাণ হারাচ্ছে হাতিও৷ বন বিভাগের হিসেবে, গত ১৩ বছরে বন্য হাতির আক্রমনে কমপক্ষে ৯৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৫
এমএন/এমএ