মাখনেরচর (দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর) থেকে: ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যার পরও মাখনেরচর, পাথরেরচর গ্রামে এসেছিল হাতির পাল। গ্রামবাসী বলছে, দলটিতে ৩০ থেকে ৪০টি হাতি ছিল।
জামালপুর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে বকশীগঞ্জ উপজেলা। সেখান থেকে আরো ৪০ কিলোমিটার পাড়ি দিলে বাঘারচর গ্রাম। জিঞ্জিরাম নদী পার হলে মাখনেরচর। জেলেরা নদী পার করে দিলো বিনা পয়সায়। পুরো এলাকাবাসীর অভিযোগ, পাশের মেঘালয় থেকে আসা হাতির পালের বিরুদ্ধে।
নদীর পাড় বেয়ে উঠলেই আমনের ক্ষেত। আরো ২০০ মিটার এগুলেই সেই স্থান, যেখানে দুটো বিশালদেহী হাতিকে বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে নির্মমভাবে হত্যা করেছে গ্রামবাসী। বিকট গন্ধে ঘটনাস্থলে যাওয়া দায়। বিশাল দেহগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয়েছে এখানেই। তারপর এখানে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। কিন্তু মৃত একটি শরীরের বড় অংশ এখনো মাটির ওপরে ফুলে রয়েছে।
মাত্র কয়েকশ’ মিটারের মধ্যেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাঁটাতার। এরপরেই পাহাড়।
পাশের ক্ষেতে কাজ করছিলেন বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ-তরুণ। এগিয়ে এলে কথা হয় বাংলানিউজের সঙ্গে। রশিদ আর আলী হোসেনরা অভিযোগ করে বলেন, গতরাতেও এসেছিল হাতির পাল। আগের রাতের ঘটনার পর হাতিরা আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।
আশপাশের ধানক্ষেতগুলো মাড়িয়ে সমান করে ফেলেছে ক্ষিপ্ত হাতির পাল। প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে তাণ্ডবের চিহ্ন। তারা জানান, আমন ধানের সময় এবং গমের সময় হাতির প্রবেশ বাড়ে। ইরি ধানের সময় একেবারেই আসে না।
রশিদ বলেন, বর্ডারের ওপারে গারো পাহাড়। ওখানটাকে বলা হয় হাতি গ্রাম। এখানে সবজায়গায় সীমানার তারকাঁটা নেই। আবার দুটি গেট রয়েছে, যেগুলো অনেক সময় খোলা থাকে। হাতির পাল সন্ধ্যা হলে এসব স্থান দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসে। আর পাহাড় থেকে নামলেই বাংলাদেশের সীমানা।
সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ এমদাদুল। বাংলানিউজকে বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই প্রতি সন্ধ্যায় আসছে হাতি। অনেক সময় আগুন জ্বালিয়ে বা ঢোল পিটিয়েও কাজ হয় না।
তিনি বলেন, ছোট বয়স থেকেই তিনি এ এলাকায় হাতির উপস্থিতি দেখতেন। তবে সেসময় এতো বেশি লোকালয়ে এসে উঠতো না হাতির পাল। একসময়তো সীমান্তই ছিল না। তখনো গ্রামে প্রবেশ করতো না।
হয়তো পাহাড়ে খাবারের সংকট হওয়ায় ফসলি ক্ষেতে এবং গ্রামে প্রবেশ করছে বলে ধারণা করছেন তিনি।
এমদাদুল বলেন, এখন হাতির যেমন তাণ্ডব বাড়ছে, তেমনি মানুষও হিংস্র হয়ে উঠেছে। দূরত্ব বাড়ছে হাতি এবং মানুষের মধ্যে।
বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ পাতা সম্পর্কে কথা বলতে নারাজ গ্রামবাসী। কারণ হাতি দুটি হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে করা মামলায় অনেক পুরুষই এখন গ্রামছাড়া।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, বেশ কয়েকটি বাঁশের খুটি পোতা হয়। সেগুলোর মধ্যে গুনা তার টেনে প্যাঁচানো হয়। এরপর বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়া হয়। শনিবার দিবাগত রাতে হাতির পাল ফেরার সময় দুটি বড় হাতি জড়িয়ে পড়ে চিকন তারে। আরো দুটি হাতিও তারে জড়িয়েছিল, তবে জোর খাটিয়ে পরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সীমানা পার হয়ে পাহাড়ে উঠে যায় তারা।
যে দুটি হাতি ধরা পড়ে, তাদের গোঙ্গানির শব্দে আশপাশের এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠে। বিশাল দেহদুটো ছটপট করতে করতে কাটা পড়তে থাকে তারে। এরপর কারা হাতির দাত, শুঁড়, কান কেটে নিয়েছে, কেউ বলতে পারেনি।
এরপর পশ্চিমে হাঁটলে প্রায় দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গত রাতের হাতির পালের তাণ্ডবের চিহ্ন। ধানক্ষেত মাড়ানো এবং বর্জ্যের চিহ্ন দেখে বোঝা যায়, দল বেঁধে লাইন ধরেই চলে হাতিরা। এরপর যে দু-চারটি ঘর, সেগুলো এখন বন্ধ। হাতির উৎপাতে ঘর ছেড়েছে মানুষ।
লোকালয়ে যাওয়ার প্রায় ১০০ বর্গমিটার জুড়ে একটি বরইয়ের বাগান। গ্রামবাসী বলছে, এখন আর বরই বাগানকেও মানছে না হাতি। পার হয়ে যাচ্ছে। তবে বরই বাগান পার হলে হাতির তাণ্ডবের চিহ্ন কম। বোঝা যায়, বরই বাগানকে সমীহ করে চলে হাতির পাল।
সোমবার সন্ধ্যার পরেই নেমেছিল হাতির পাল। গ্রামবাসী দূরে লণ্ঠন ও ঢোল নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। সেই সীমা অতিক্রম করে না হাতি।
মোছাম্মদ আনোয়ারা বেগমের ধানের জমি মাড়িয়েছে হাতির দল। নিংড়ে ফেলা ফসল দেখিয়ে তিনি বলেন, তিনফুট উচুঁ ধান গাছগুলো শুঁড় দিয়ে কেটে মধ্যাংশ খেয়ে নেয়। এবং দেড়ফিটের মতো পাকা শস্যের উপরের শীষ ও ধান খেয়ে ফেলে।
কথা হয় গ্রামের সাবেক মেম্বার রইছউদ্দিনের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, প্রশাসন থেকে কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি এখন পর্যন্ত। এছাড়াও হাতি তাড়ানোর কোন কৌশল এখন পর্যন্ত গ্রামবাসীকে দেখানো বা শেখানো হয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
গ্রামবাসী জানায়, যেসব কৌশল তারা প্রয়োগ করে, সেগুলো একান্তই নিজেদের উদ্ভাবিত কৌশল। সেগুলোতে অনেক সময় হাতি বাঁধ মানে না। উল্টো তেড়ে আসে, তখন জান নিয়ে পালায় গ্রামবাসী।
এভাবেই দূরত্ব বাড়তে থাকে হাতি এবং মানুষের। মঙ্গলবার সন্ধ্যায়ও নামতে পারে হাতির পাল।
** ঐ-তে ঐরাবত, ঐরাবত আমরা ফেলছি মেরে…
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৫
এমএন/জেডএম