রাজশাহী: রাজশাহীতে পদ্মানদী ও সাধারণ মানুষের বিনোদন একই সূতোই গাঁথা। শহরের কোলঘেঁষে বয়ে চলা এ নদীর তীরে প্রতিদিন বিকেলে ভিড় জমান অসংখ্য মানুষ।
এর মধ্যে রয়েছে লালন শাহ পার্ক ও উন্মুক্ত মঞ্চ। এতোদিন বিনা খরচে মঞ্চ ব্যবহার করা যেতো, পার্কে ঘোরা যেতো। কিন্তু স্থানটি আর উন্মুক্ত থাকছে না।
নদী দেখতে আসা দর্শনার্থীদের ঢুকতে এখন টাকা গুনতে হবে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হবে। এরই মধ্যে স্থানটি ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু করেছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)।
এর প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছেন নগরবাসী। নদীর তীর ঘেঁষে প্রায় প্রতিদিনই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (০৫ নভেম্বর) এলিজ্যাবল ইয়ুথ ফর ইভোলিউশন নামের একটি সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এর আগে গত ৩০ অক্টোবর মানববন্ধন করে তীব্র প্রতিবাদ জানায় স্বাধীনতা চর্চা কেন্দ্র নামের একটি সামাজিক সংগঠন।
সারা বছর পদ্মানদীতে সর্বোচ্চ তিন মাস পানিতে টইটুম্বুর থাকে। বাকি সময় কেবলই ধূ-ধূ বালুচর। নদীর এপার-ওপার ঘিরে কেবল ছোট নালার মতো পানি দেখা যায়। তারপরও সারা বছরই মানুষের আনাগোনা থাকে পদ্মাতীরে।
রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলী বরজাহান বলেন, পদ্মানদীর তীরে ওই স্থানটিতে সাধারণ মানুষ অবাধে চলাফেরা করতেন। সেটি বন্ধ করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত করছে রাসিক। এতে পদ্মাতীরের সৌন্দর্যহানি তো হচ্ছেই, মানুষও বিনোদনের সুযোগ হারাচ্ছেন।
পদ্মাপাড়ে ঘুরতে যাওয়া ফয়সাল আলম নামের এক তরুণ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার কথা তিনি শুনেছেন। কিন্তু উন্মুক্ত পদ্মাপাড়ে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা তিনি কখনও শোনেননি। তার প্রশ্ন, নদীর তীর জনগণের সম্পদ। এটি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরতে হবে কেন?
ফয়সাল আলমের মতে, নির্মল ওই বিনোদনকেন্দ্রটি জনগণই রক্ষণাবেক্ষণ করবে। কিন্তু সেই সম্পদ ঘিরে দর্শনার্থীদের কাছে টিকিটের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হবে, ফাস্টফুডের দোকান বসানো হবে, তা কোনোভাবেই হতে দেওয়া হবেনা। প্রয়োজনে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
মৃতপ্রায় পদ্মাকে ঘিরেই রাজশাহীতে গড়ে উঠেছে মনোরম বিনোদনকেন্দ্র। নগরীর পশ্চিম দিকে বুলনপুর থেকে শুরু করে পূর্বে তালাইমারী পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পদ্মার তীরজুড়ে এর বিস্তৃতি। রাসিকের সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের আমলে এ পার ঘিরে প্রায় শত কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাÐ বাস্তবায়িত হয়। সিটি করপোরেশনের বাইরে বেসরকারি উদ্যোগেও গড়ে উঠেছে পার্ক, ফাস্টফুড, রেস্তোরাঁসহ নানা প্রতিষ্ঠান। তাই পদ্মার শুষ্ক চরই নগরীর বড় বিনোদনকেন্দ্র।
আর লালন শাহ মঞ্চের আঁকাবাঁকা সিঁড়ির মতো সাজানো-গোছানো গ্যালারিতে বসে অনায়াসে দেখা যায় পদ্মার রূপ। বর্ষায় দেখা মেলে পালতোলা নৌকার ছুটে চলার মনোরম দৃশ্য।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন এ মঞ্চের দেখভাল করে। এখানে যেকোনো বড় অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে বিস্তৃত মুক্তমঞ্চ।
তবে লালন শাহ পার্ক ইজারা দিতে উঠে পড়ে লেগেছে সিটি করপোরেশন। গত বছরের জুনে এর দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরপর তা বাতিলও করা হয়। তবে নতুন করে আবার এটি ইজারা দিতে তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন নগরীর ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম রাশেদুল হাসান।
তিনি জানান, গত বছরের ২৬ জুন দরপত্র আহ্বানের পর জেলা বিএনপির সাবেক নেতা খন্দকার হাসান কবিরকে ইজারা দিতে সব প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। কিন্তু পার্কটি ইজারার পর সেটি কীভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করতে পারেনি রাসিক। ফলে আইনি জটিলতায় শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটি আটকে যায়।
বর্তমানে জটিলতা কাটিয়ে লালন শাহ পার্কটি ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। ইজারা পাওয়া ব্যক্তির সঙ্গে বসে পরবর্তীতে শর্ত ঠিক করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাসিক।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক জানান, তারা লালন শাহ পার্কটি ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। খোলা অবস্থায় কেউ তা নিতে রাজি হবেন না। এ কারণে পার্কের এলাকাটি ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। পাঁচ টাকার টিকিট কেটে দর্শনার্থীরা ভেতরে যেতে পারবেন। এতে রাসিকের আয়ও বাড়বে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম উল আযিম বলেন, সিটি করপোরেশনের আর্থিক দুরবস্থার কথা সবারই জানা। পার্কটি ইজারা দিলে রাজস্ব আয় বাড়বে। তাছাড়া, ওই মঞ্চের বিভিন্ন জিনিসপত্র স্থানীয়রা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। এটি রক্ষণাবেক্ষণেরও প্রয়োজন। কিন্তু করপোরেশনের জনবল দেওয়াও সম্ভব নয়। তাই এর সৌন্দর্য ও সম্পদ রক্ষায় ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সময় নগরীর পাঠানপাড়া এলাকায় ২ দশমিক ৫৫ একর জমির ওপর ৩ কোটি ১ লাখ টাকা ব্যয়ে লালন শাহ পার্ক ও ফুডকোর্টটি নির্মাণ করা হয়। এতোদিন পার্কটিতে কোনো ফি ছাড়াই নগরবাসী যেতে পারতেন। পার্কের উন্মুক্ত মঞ্চটি ব্যবহার করা যেতো কোনো ফি ছাড়াই। তবে নতুন করে আবার পার্কটি ইজারা দিতে যাচ্ছে রাসিক।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৫
এসএস/এএসআর