ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

মহাসড়কের প্রবেশপথেই অবৈধ স্ট্যান্ড!

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৫
মহাসড়কের প্রবেশপথেই অবৈধ স্ট্যান্ড! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে অনেক আগ থেকে। অবাক করা ব্যাপার, ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের শুরুতেই নগরীর চরপাড়া মোড়ে গড়ে উঠেছে নিষিদ্ধ এ যানের স্ট্যান্ড।

কেবল তাই নয়, চকচকে স্বপ্নের মহাসড়কের সূচনা পয়েন্টের দু’পাশ দখল করে অবৈধভাবে গজিয়ে উঠেছে টেম্পো, মাহেন্দ্র, লেগুনা ও অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্যান্ডও।

মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ এ পয়েন্টের প্রায় ৩শ’ গজের মধ্যে এসব অবৈধ স্ট্যান্ডের ‘জঞ্জালে’ তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিন। অবৈধ এসব স্ট্যান্ড থেকে ওঠা চাঁদার টাকা যাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ ও শ্রমিক নেতাদের পকেটে। আর তাদের অবৈধ বাণিজ্যের খেসারত দিতে হচ্ছে শহরবাসী ও পথচারীদের।

গত ক’দিন সরেজমিনে নগরীর চরপাড়া মোড় এলাকা ঘুরে দেখা মিলেছে এমন চিত্রের। তবে অবৈধ এসব স্ট্যান্ডের যন্ত্রণা ও বাণিজ্য কাহিনী সবার মুখে মুখে থাকলেও ময়মনসিংহের ট্রাফিক ইন্সপেক্টরের ভাষ্যে, ‘এ পয়েন্টে কোনো অবৈধ স্ট্যান্ড নেই’।

সরেজমিনে দেখা যায়, চরপাড়া মোড়ের ডান দিকে বড়সড় জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা থেকে বিতাড়িত টু-স্ট্রোক টেম্পো। গজিয়ে উঠা এ স্ট্যান্ডে দিন-রাত প্রায় অর্ধশতাধিক টেম্পো সড়ক দখল করে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকে। এ টেম্পোর বিকট ও উচ্চ শব্দে কানঝালাপালা পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের।

পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ফিটনেসবিহীন এসব টেম্পো স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ করেন মামুন নামের একজন। এ তথ্য দেন সদর উপজেলার দাপুনিয়া এলাকার বাসিন্দা টেম্পো চালক আনোয়ার ও মোস্তাক। এজন্য টেম্পোপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

মহাসড়কের প্রবেশপথেই অবৈধ টেম্পো স্ট্যান্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে মামুন নামে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘প্রশাসন কী করবো। প্রায় ১০ বছর যাবত আমি এখানে স্ট্যান্ড পরিচালনা করে আসছি। চা-পান বাবদ টেম্পো চালকরা আমাকে ১০ থেকে ২০ টাকা দেয়। এটা তো দোষের কিছু না। ’

অবৈধ টেম্পো স্ট্যান্ড পেরিয়ে মহাসড়কের ওই পাশে একটু এগিয়ে যেতেই কানে আসে কিশোর এক মাহেন্দ্র চালকের হাঁক ‘এই চুরখাই, চুরখাই’। চালকের নাম আব্দুল আউয়াল। তিনি জানান, প্রতিদিন এখান থেকে ২০ থেকে ২৫টি তিন চাকার মাহেন্দ্র মহাসড়কের সদর উপজেলার চুরখাই পর্যন্ত চলাচল করে।

মহাসড়কে তো থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ। তবু কীভাবে চলছে এ যান? এ প্রশ্ন করতেই স্মিত হেসে আউয়াল বলেন, পুলিশরে ম্যানেজ কইরাই তো চালাইতাছি। প্রতি মাহেন্দ্র ২শ’ টাকায় ট্রাফিক পুলিশ চুরখাই পর্যন্ত রোড দিছে।

এরপর সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরেই চম্পট দিলেন আউয়াল। এ সময় যাত্রীবিহীন বেশ কয়েকটি মাহেন্দ্র চালককেও এ স্পট থেকে দ্রুত কেটে পড়তে দেখা গেলো।

মহাসড়কের এ সূচনা পয়েন্টে দুর্ভোগ-বিড়ম্বনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ অবৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড। সরেজমিনে দেখা যায়, চার লেনের মহাসড়কের দু’লেনের প্রায় অর্ধেকটা জায়গাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি সিএনজি। রিজার্ভ চুক্তিতে এখান থেকে চুরখাই পর্যন্ত যায় তিন চাকার এ যান।

কখনও কখনও পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব অটোরিকশা আবার যায় ত্রিশাল পর্যন্ত। তবে বেশিরভাগ চালক দাবি করলেন, এ পয়েন্ট থেকে তারা নেত্রকোনাতেই ট্রিপ মারেন।

আলাপ হলো কিশোর সিএনজি চালক জুয়েলের (২০) সঙ্গে। বললেন, ‘সদর উপজেলার চুরখাই পর্যন্তই সিএনজি চলে’। চার লেনের মহাসড়কের ওপর কীভাবে স্ট্যান্ড হলো? জানতে চাইলে এ কিশোর চালক বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশই আমগরে জায়গা দিছে’। কৌশলী এ চালক পরক্ষণেই বললেন, ‘এই রোডে কোন গাড়ি যায় না। ঘুইরা ঘুইরা ত্রিশালে যাইতে হয়’।

জুয়েলের কাছ থেকে জানা গেলো মহাসড়ক দখল করে অবৈধ এ স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছেন সোহেল নামে একজন। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় পরিচালিত এ স্ট্যান্ডের দেখভাল করেন রুহুল আমিন মেঘনা (৩০) নামে এক যুবক। সামনে এগোতেই দেখা হলো মেঘনার সঙ্গে।

মহাসড়কে অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ার কৌশলও জানা গেলো তার কণ্ঠে, ‘এখানে সিএনজি নামালে ট্রাফিক পুলিশকে সম্মানির জন্য দুই হাজার টাকা দিতে হয়। ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মাহাবুব স্যার পিএ রাইখা দিছে। তিনিই মালিকদের কাছ থেকে টাকা তুলেন। এরপর এ স্ট্যান্ডে জিপি বাবদ চালকদের প্রতিদিন ৪০ টাকা দিতে হয়। এ টাকার ফিফটি ফিফটি পুলিশ-শ্রমিক। ’

আলাপচারিতায় মেঘনা বলতে থাকেন, ‘পুলিশই আমগরে স্ট্যান্ডের জায়গা দিছে। আর শ্রমিকরা কইরা খাইতাছে। এখন এখানে অর্ধশতাধিক সিএনজি আছে। ’

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের সড়কের অর্ধেকটাই অ্যাম্বুলেন্স চালকদের কব্জায় চলে গেছে। মহাসড়কের ওপর এ স্ট্যান্ডের কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড চালক কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক উজ্জ্বল বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভেতরে আমাদের অ্যাম্বুলেন্স রাখতে দেয় না। বাধ্য হয়েই মহাসড়কের ওপর এ স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। ’

ত্রিশালের একটি গেটলক সার্ভিসের বাসচালক বলেন, ‘সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কঠোর নির্দেশের পরেও মহাসড়কের ওপরেই সিএনজি, লেগুনা, বেবী, মাহেন্দ্র ও অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড বহাল তবিয়তে রয়েছে। এতে ওই এলাকায় প্রতিনিয়তই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। রহস্যজনক কারণে পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ’

মহাসড়কের সূচনা পয়েন্টে এসব অবৈধ স্ট্যান্ডের বিষয়ে ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের চার লেন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা এসব স্ট্যান্ডের জন্য জায়গা লিজ দেইনি। স্থানীয় প্রশাসনই এর জন্য দায়ী। এবারের জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এসব অবৈধ স্ট্যান্ড দ্রুত উচ্ছেদের দাবি জানানো হবে। ’

তবে এ বিষয়ে ময়মনসিংহের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সৈয়দ মাহাবুবুর রহমান দাবি করেন, ‘চরপাড়া এলাকায় অবৈধ কোনো স্ট্যান্ড নেই। এখানে থ্রি হুইলারসমূহ রানিংয়ের ওপরে থাকে। এসব যানের কারণে কোনো যানজট হয় না। ’ অবৈধ বাণিজ্যের বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৫
এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।