ঢাকা: বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশাপাশি নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরাও। দলের সহ অধিনায়ক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে জন্মের সে সময়ে জন্মভূমিকে সাহায্য করতে পেরে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও গর্বে ভরে ওঠে তার বুক।
তিনি জানান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা দিতে ও বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি প্রীতি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির আওতায় গঠিত স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ম্যাচগুলো খেলে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের (মুজিবনগর সরকার) হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন তারা। এ অর্থ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বেশ কাজে লাগে।
সম্মুখযুদ্ধে অংশ না নিয়েও দেশমাতৃকার কল্যাণে নিজেদেরকে আত্ননিয়োগ করেছিলেন দলটির ৩২ সদস্যের ফুটবলযোদ্ধা, কোচ-কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা। মাঠের লড়াইয়ের মাধ্যমে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছিলেন জন্মভূমির মুক্তির লড়াইয়ে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হাত থেকে পরাধীন এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন করতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে লড়াই করেন রণাঙ্গনে। আর বাইরে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যান সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। মুক্তিকামীদের কাতারে সেদিন যারা সক্রিয় ছিলেন তারা কেউ ছিলেন চিকি ৎসক, কেউ নার্স আর কেউবা শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক। আর ছিলেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরাদের মতো ক্রীড়াযোদ্ধারা।
বাংলার একঝাঁক দামাল ছেলেকে নিয়ে গড়া স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলটিরও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিলো। অস্ত্র হাতে নয়, তাদের সেই অংশগ্রহণটি ছিলো সম্পূর্ণ নিরস্ত্র হাতে এবং দেশান্তরি হয়ে। তারা দেশ ছেড়েছিলেন মাতৃভূমির পক্ষে জনসমর্থন অর্জনে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবলে অংশ নিয়ে তারাও হয়ে উঠেছিলেন মুক্তির সংগ্রামের অংশ।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের পেছনের ইতিহাসও তুলে ধরেন দলটির সহ অধিনায়ক প্রতাপ। তিনি জানান, মুজিবনগর সরকার শামসুল হক এমএনএ’কে সভাপতি, লুৎফর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক এবং মোহসিনকে কোষাধ্যক্ষ করে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি গঠন করে। এর আওতায় গড়া স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও শহরে ফুটবল খেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
একাত্তরের ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে সহায়-সম্বল সব হারিয়ে কলকাতায় চলে যান প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলটি গঠনের জন্য প্রথমেই ডাকা হয় তাকে।
প্রতাপ বলেন, ‘১৯৭১ এর জুন মাস। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের ডাক পেয়ে আমি বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী ঠিকানা কলকাতার থিয়েটার রোডে আসি। সেখানে দেখা হয় বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সভাপতি সামসুল হক এমএনএ’র সঙ্গে। আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, একটি ফুটবল দল গঠন করা যায় কি-না। আমি হ্যাঁ সুচক উত্তর দিলে একটি সভা ডাকা হয়। সভায় একটি ফুটবল দল তৈরির জন্য ননী বসাক, জাকারিয়া পিন্টু ও আমাকে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সদস্য করে নেওয়া হয়। সেই সভায়ই জাকারিয়া পিন্টুকে অধিনায়ক এবং আমাকে সহ অধিনায়ক করা হয়। আর ননী বসাক মনোনীত হন কোচ হিসেবে’।
‘সভায় ফুটবল দল তৈরি সংক্রান্ত আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ছিল, বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে যতো বাংলাদেশি খেলোয়াড় আছেন, তাদের ফুটবল ক্যাম্পে যোগ দিতে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারণার ব্যবস্থা করা। এছাড়া তখন যে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছিলেন, তাদের বলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় যে, তারা যেন পরিচিত ভালো খেলোয়াড়দের কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল ক্যাম্পে যোগ দেওয়ানোর ব্যবস্থা নেন’।
‘এভাবে খেলোয়াড় সংগ্রহ করে আমরা আমাদের ৩২ সদস্যের দল গঠন করেছিলাম’- বলছিলেন প্রতাপ শঙ্কর।
৩২ সদস্যের বাংলাদেশ স্বাধীন বাংলা দলে ছিলেন- ননী বসাক (কোচ), জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শঙ্কর হাজরা (সহ অধিনায়ক), অমলেশ সেন, খন্দকার নুরুন্নবী, আলী ইমাম, কায়কোবাদ, আইনুল হক, বিমল কর, আশরাফ আলী, শাহজাহান আলম, শেখ মনসুর আলী লালু, এনায়েতুর রহমান, নওশেরউজ্জাসান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, ফজলে সাদাইন খোকন, কাজী মো: সালাহউদ্দিন, আব্দুল হাকিম, মো: তোসলেম উদ্দিন শেখ, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, আব্দুল মোমেন জোয়ার্দার, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি, আব্দুস সাত্তার, গোবিন্দ কুণ্ডু, নিহার কান্তি দাস, মজিবুর রহমান, লুৎফর রহমান খান, সঞ্জিত কুমার দে, মাহমুদুর রহমান রশিদ, সাইদুর রহমান প্যাটেল ও দেওয়ানে মো: সিরাজউদ্দিন সিরাজ। আর তানভির মাজহার তান্না ছিলেস টিম ইনচার্জ (ম্যানেজার)।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ অধিনায়ক আরও জানালেন, দল গঠনের পর প্রথম দিকে খেলোয়াড়রা থাকতেন কর্নানি স্টেটে। আগস্টের শেষে সবাই চলে আসেন চৌরঙ্গির মল্লিক ম্যানশনে।
‘এ দল নিয়ে আপনারা কতোগুলো ম্যাচ খেলেছিলেন এবং কয়টিতে জিতেছিলেন?’- উত্তরে প্রতাপ শঙ্কর বলেন, জুলাই থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ১৪টি ম্যাচ খেলেছি। এর মধ্যে ৩টিতে হেরেছি, বাকি ১১টিতেই জিতেছি। এর মধ্যে প্রথম ম্যাচটি ছিল নদীয়া একাদশের বিপক্ষে ২৪ জুলাই, যা ২-২ গোলে ড্র হয়। দ্বিতীয়টি গোষ্ঠপাল একাদশ, তৃতীয়টি দক্ষিণ কলকাতা (রবীন্দ্র সরোবর) একাদশ, চতুর্থটি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন একাদশ, পঞ্চমটি দুর্গাপুর একাদশ, ষষ্ঠটি বর্ধমান একাদশ, সপ্তমটি পূর্ণিয়া একাদশ, অষ্টমটি সিওয়াল একাদশ, নবমটি উত্তরপ্রদেশ একাদশের বিপক্ষে বানারসে, দশমটি আসানসোল একাদশ, একাদশটি মহারাষ্ট্র একাদশ (অধিনায়ক ছিলেন মনসুর আলী খাল পতৌদি), দ্বাদশ ও ত্রয়োদশটি ছিল বালুঘাট একাদশ আর চতুর্দশ খেলাটি ছিল মুর্শিদাবাদ একাদশের বিপক্ষে।
বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
এইচএল/এএসআর