ঢাকা: ১৬ ডিসেম্বর- মহান বিজয় দিবস, বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। হাজার বছরের ইতিহাসেরও শ্রেষ্ঠতম দিন এটি।
বিভিন্ন শাসনামলের মধ্য দিয়ে বাঙালি যুগে যুগে ছিল পরাধীন- নয়তো যৌথভাবে অধীন। মুক্তির স্বাদ এককভাবে না মেলা এ জাতির ‘একটি জাতি’ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময়-সুযোগ হয়ে ওঠেনি তেমনভাবে কখনও। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং একজন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির হাত ধরে পূর্ব বাংলার মানুষ ধাবিত হয় শ্রেষ্ঠত্বের দিকে।
স্বাধীনতার ডাক এবং দীর্ঘ নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে আমরা শ্রেষ্ঠত্বের বিজয় ছিনিয়ে আনি।
এবারের বিজয় দিবস একটু অন্যভাবেই উদযাপিত হবে। একটু একটু করে কলঙ্কমুক্তির পথে দেশ। সম্প্রতি দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে দায়মুক্তি আরও একধাপ এগিয়ে গেছে।
এছাড়া এবার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে প্রথম বিজয় দিবস উদযাপিত হবে। দেশ স্বাধীনের এতো বছর পর এই ভূখণ্ড অর্জন একটি বড় বিষয়। সার্বিকভাবে এবারের বিজয়ের আনন্দ আরও গভীর এবং তরতাজা হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়ের অবিস্মরণীয় দিন- ১৬ ডিসেম্বর। লাখো শহীদের রক্তস্নাত বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর আমাদের দিয়েছে বিশ্ব দরবারে একটি দেশ। মানচিত্রে নতুন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের ৪৪ বছর পূর্তি বুধবার।
পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নিপীড়ন আর দুঃশাসনের কুহেলিকা ভেদ করে ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে বিজয়ের প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠেছিল বাংলাদেশের শিশির ভেজা নরম মাটি। অবসান হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কৃষ্ণতম অধ্যায়ের। নারী-পুরুষ-শিশু সবার চোখে ঠাঁই পেয়েছিল সীমাহীন আনন্দের অশ্রু, সঙ্গে এক বুক পবিত্র দেশপ্রেম। বিজয়ের অনুভূতির ঝিলিক সেদিন যারা দেখেছিলেন তারা ভাগ্যবান। আর তার চেয়েও ভাগ্যবান যারা এই স্বাধীন দেশে- স্বাধীন নাগরিক হিসেবে জন্মেছেন।
সব মিলিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির অনুভূতি সর্বোচ্চ আনন্দের!
মূলত ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেটির উদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
এদিন ৯১ হাজার ৫৪৯ পাকিস্তানি সৈন্য প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করে হার মেনে দেশে ফিরে যান। ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন।
কোনো দেন-দরবার নয়, কারো দয়া কিংবা দানে নয়, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পর নতমস্তকে পরাজয় মেনে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। পৃথিবীতে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণ একদিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে এ জাতির রক্ত-ঘাম ঝরানোর সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের মহান সেনাপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু মানেই আমাদের নতুন অস্তিত্ব। ৫৫ হাজার বর্গমাইল জুড়েই তার অস্তিত্ব সর্বদা বিদ্যমান। তাই তো- ‘যতো দিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান। ততোদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।
ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনামলে বাঙালি রক্ত দিয়েছে। লড়াই করেছে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে। সোয়া ২শ’ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম ও লড়াইয়ে রক্ত দিয়েছে এই বাঙালি জাতি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনেও ছিল বাঙালিদের অবদান। বাঙালিরাই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর। কিন্তু কয়েক বছরেই বাঙালির মোহভঙ্গ হয়। যে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তারা ইংরেজদের বিতাড়িত করেছিল সেই একই রকম শোষণ বঞ্চনার মুখোমুখি হয়ে পড়ে কয়েক বছরের মধ্যেই। শুরু হয় সংগ্রামের নতুন যুগ। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত করতো বাঙালিদের।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থান এ সবই ইতিহাসের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন সব পরিণতিকে দিয়ে দেয় চূড়ান্ত রূপ। শুরু হয় নতুন অধ্যায়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে আসে বঙ্গবন্ধুর বজ্রনিনাদ ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ঘোষণা জাতির মনে বয়ে আনে অন্য এক প্রেরণা, জাগিয়ে তোলে মুক্তির উন্মাদনা। শুরু হয় বিশ্বের অন্যতম সেরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির যুদ্ধ।
মহান বিজয় দিবস উদযাপনে নতুন সাজে সেজেছে বাংলাদেশ। সারাদেশ ছেয়ে গেছে লাল-সবুজ পতাকায়। নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি।
সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে নামবে শহীদদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ জনগণের ঢল। বীর শহীদদের মহান ত্যাগের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞ জাতি শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। দেশব্যাপী বিভিন্ন ভবনের ছাদে পতপত করে উড়বে আমাদের লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা।
এদিকে, বিভিন্ন স্থাপনা- হাসপাতাল, কারাগার, এতিমখানা, ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোতে সকাল থেকে পরিবেশন করা হবে উন্নতমানের খাবার। দেশের অব্যাহত শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় বিশেষ দোয়া-মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
আইএ/এএসআর