ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

চলনবিলের সুখ দুঃখ -২

জলাধারের বুকে হলুদ-সবুজের খেলা!

বেলাল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
জলাধারের বুকে হলুদ-সবুজের খেলা! ছবি: আরিফ জাহান / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চলনবিল থেকে ফিরে: প্রায় ৮০০ বর্গমাইল আয়তনের চলনবিলে ছিল বিশাল জলরাশি। বর্তমানে সেই বিলই জলের অভাবে খাঁ খাঁ করছে।

মাঝে মধ্যে কিছু কিছু স্থানে ছিটেফোটা জলের দেখা মেলে। আবার ছোটখাটো কিছু খানা-খন্দক সামান্য জল বুকে ধারণ করে মরার মতো বেঁচে আছে।
 
এক সময়কার বিশাল এ জলাধারের মাইলের পর মাইল এলাকায় এখন সরিষার চাষ হচ্ছে। বিলটি তাই ছেয়ে আছে হলুদের আভরণ আর সবুজের সমারোহে, যা পথিকের দৃষ্টিসীমাকেও ছাপিয়ে যায়।

সরিষার পাশাপাশি চলতি মৌসুমের ধান চাষের জন্য জমি প্রস্তুতির কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা।

শুকনো মৌসুমে বিলে চলে রকমারি ফসলের চাষ। বর্ষায় অবশ্য এখনো আশ্রয় নেয় মাছ। তবে দিন দিন ফসলে ভিন্নতা ও চাষের আওতা বাড়লেও ঠিক এর বিপরীতটি ঘটছে মাছের ক্ষেত্রে। মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিকূলতার কারণে চলনবিল প্রায় দেশীয় মাছশূন্য হয়ে পড়েছে।  

সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা ও নওগাঁর ৯টি উপজেলার অংশ বিশেষ নিয়ে চলনবিল গঠিত। বিল এলাকায় দেড় হাজারের অধিক গ্রাম রয়েছে। এখানকার লোক সংখ্যা ২০ লাখের অধিক। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে খাল খনন প্রকল্পের মাধ্যমে চলনবিলকে আবাদিকরণের জন্য জাগিয়ে তোলার উদ্যোগে নেওয়া হয়। তখন থেকেই মূলত চলনবিলে মাছের পাশাপাশি ফসলের চাষ শুরু হয়।
 
প্রবীণ সাংবাদিক রুহুল আমীন বাংলানিউজকে জানান, এককালে চলনবিলে বছরজুড়ে থাকতো পানি আর পানি। যেখানে ছিল বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ সম্পদের প্রাচুর্য। বর্ষা ও শুকনো- দুই মৌসুমই ছিল সমান। তখনকার দিনে চলনবিলের চারদিক কেবল পানিতে থই থই করতো।

ষাটের দশকে দেশের কৃষি সেক্টরে পাওয়ার পাম্প যুক্ত হওয়ায় এর প্রভাব চলনবিল এলাকার কৃষকদের মধ্যেও পড়ে। সে সময় কৃষকরা এখানে চায়না ইরি বোরো-৮ ও আমন ধানের চাষ করতেন। সত্তর দশকের শেষদিকে এখানকার কৃষকদের হাতে আসে শ্যালোমেশিন প্রযুক্তি। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত চলনবিলে ব্যাপক আকারে তরমুজের চাষ চলতে থাকে। কিন্তু এর কয়েক বছরের মাথায় বাজার ব্যবস্থা ও ভেজাল সমস্যার কারণে কৃষকরা প্রচণ্ড মার খান। ফলে তারা আবাদের তালিকায় পরিবর্তন আনেন।

তিনি আরো জানান, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে চলনবিলে ব্যাপক আকারে রকমারি ফসলের চাষ শুরু হয়। ১৯৯০ সালে ভাঙ্গুরা, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর ও ফরিদপুর উপজেলায় চলনবিলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সরিষার চাষ শুরু হয়। প্রতি মৌসুমে এসব এলাকায় সরিষার চাষ বাড়তেই থাকে। তাদের সাফল্য দেখে ২০০৪ সালে বিলটির তাড়াশ অংশের কৃষকরাও সরিষা আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাড়াশের পাশাপাশি সিংড়াসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার কৃষকরাও সরিষার চাষ করতে শুরু করেন।  
 
রেজাউল করিম, আবদুল হান্নান, আবদুল মজিদসহ কয়েকজন কৃষক বাংলানিউজকে জানান, সরিষা চাষের পর থেকে ফসল ঘরে ওঠা পর্যন্ত যে সময় লাগে তাতে বোরো মৌসুমে ধান চাষে কোনো সমস্যা হয় না। তাই তারা সরিষার চাষ করে থাকেন।
 
অন্যদিকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে সেখানে রকমারি সবজির চাষ শুরু হয়। এর পাশাপাশি গম, ভুট্টা, রসুন, পেঁয়াজ, করলা, খেসারি ও মাসকলাইয়ের চাষ করা হয়ে থাকে। এবারো ব্যতিক্রম ঘটেনি। রেকর্ড পরিমাণ জমিতে এসব ফসলের চাষ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে সরিষা ও রসুনের আবাদ এগিয়ে রয়েছে বলে জানান কৃষকরা।
 
সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসগুলো জানায়, চলতি মৌসুমে কৃষকরা চলনবিল এলাকায় রেকর্ড পরিমাণ জমিতে সরিষা, রসুন, পেঁয়াজ, ভুট্টা, চিনাবাদাম, শাক-সবজি, মসুর, খেসারি ও মাসকলাইয়ে চাষ করেছেন। পাশাপাশি রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের চাষ করেছেন কৃষকরা। এছাড়া বোরো ধান চাষের জন্য জমি প্রস্তুতির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
 
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বগুড়া অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ হযরত আলী বাংলানিউজকে জানান, চলনবিল এখন বিশাল শস্যভাণ্ডার। বর্তমানে এখানে রকমারি ফসলের চাষ হচ্ছে।
 
তিনি বলেন, কৃষকদের এক ফসলে নির্ভর হলে চলবে না। কেননা, এক ফসল মানে ধান চাষে তাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচের খরচ বাড়ে। দাম কম থাকার কারণে তাদের লোকসান গুণতে হয়। তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না।
 
তাই কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের বহু ফসল চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এতে সারা বছর কৃষক ফসল পাবেন, কাজ থাকবে। কর্মসংস্থানের নতুন নতুন উৎস সৃষ্টি হবে। কৃষকের আয় বাড়বে। মাটির স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।

চলনবিলসহ বৃহত্তর বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার কৃষকদের রকমারি ফসলের চাষে উৎসাহী করতে কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
এমবিএইচ/এএসআর

**  অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে বিপন্ন বিশাল জলরাশি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।