চলনবিল থেকে ফিরে: মানুষের জন্য আশীর্বাদ দেশের জলসম্পদ। জীব ও জীবনযাত্রার পথে শক্তি সঞ্চার করে এ সম্পদ।
প্রাকৃতিক মৎস্য ভাণ্ডারখ্যাত চলনবিলের জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদ ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা আর পরিকল্পনার অভাবে বিলটির মৎস্য সম্পদের বিকাশ বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন না সংশ্লিষ্টরা। ভবিষ্যতেও ভাববেন কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ-সংশয় রয়েছে।
অথচ গুরুত্ব দিয়ে মাছের উৎপাদন, আহরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে প্রতি বছর চলনবিল থেকেই অতিরিক্ত প্রায় ৩০-৩৫ হাজার মেট্রিকটন মাছের উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
২০০৭ সালের ৪ এপ্রিল সরকারের ভূমি ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় কেবলমাত্র চলনবিলের জলমহালগুলো উন্নয়ন করে মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশ উন্নয়ন ও অভয়াশ্রম স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে।
চুক্তি অনুসারে তৎকালীন সময়ে বিলটির ৭৮টির মতো জলমহাল মৎস্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে ভূমি মন্ত্রণালয়।
হাজার হাজার দরিদ্র জেলে পরিবারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হলেও এ পর্যন্ত কতোটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তা কেউ সঠিক করে জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বছর বছর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পলি মাটি এসে জমার কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল উন্নত হলেও চলনবিল তার গতিপথ থেকে ক্রমেই দক্ষিণে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, চলনবিলে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর প্লাবনভূমি ও ২০ হাজার হেক্টর স্থায়ী জলাশয় রয়েছে। কেবল সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে স্থায়ী জলাশয়গুলোর সরাসরি প্রভাব পড়ায় প্লাবনভূমির জলাশয়গুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। এছাড়া বংশ বিস্তার ও মা মাছ সংরক্ষণের জন্য কোনো অভয়াশ্রম নেই। ফলে সেখানে পর্যাপ্ত মাছের পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
সরেজমিনে গেলে মাছের পোনা উৎপাদিত না হওয়ার বাধা সম্পর্কে সাইফুল ইসলাম, আবু তালেব, শফিকুল ইসলাম, আব্দুল হামিদসহ কয়েকজন মৎস্যচাষী বাংলানিউজকে জানান, এক সময় দেশের বিভিন্ন প্রধান নদ-নদীর সঙ্গে ছোট ছোট শাখা নদীর মাধ্যমে চলনবিলের সংযোগ ছিল। সেসব সংযোগস্থল দিয়ে চলনবিলে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতি মাছ ও পোনা অবাধে প্রবেশ করতে পারতো। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই।
এর কারণ সম্পর্কে প্রবীণ সাংবাদিক রুহুল আমীন বাংলানিউজকে জানান, ষাটের দশকে রংপুরের কাউনিয়া থেকে শাহজাদপুরের ভড়াখোলা পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় প্রায় বাঁধের মতোই সড়কও নির্মাণ করা হয়। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে চলনবিলের ওপর।
এসব কারণে বিলটিতে বিভিন্ন দিক থেকে আসা মাছের প্রবেশপথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া অবাধে বিভিন্ন কীটনাশকের ব্যবহার, ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া, অনাবৃষ্টি, কারেন্ট জালের ব্যবহার, অভয়াশ্রম না থাকা, সূতিজাল দিয়ে কোটি কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ নিধন করা এবং একাধিক স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কারণে মাছের বংশ বিস্তার প্রচণ্ড হুমকির মুখে পড়ে।
মানুষের তৈরি নানামুখী সমস্যার কবলে ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি থেকে মৎস্য সম্পদ ব্যাপক হারে কমতে শুরু করে। অথচ আশির দশকেও বিলটিতে প্রায় ৭৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। এর মধ্যে শিং, মাগুর, কৈ, শোল, টাকি, গজার, চিতল, বোয়াল, বেলে, আইড়, চাঁদা, বাতাসি, বাইম, সরপুঁটি, টেংরা, মলা, চিংড়ি, শিলং, পাবদা, গোচি, বাটা, কাকিলা, মেনি, রুই, কাতলা, কালবাউস উল্লেখযোগ্য।
২০০২ সালের পর থেকে চলনবিলে এসব প্রজাতির মাছের অধিকাংশই পাওয়া যায় না।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ১৯৮০ সালে আহরিত মাছের তুলনায় ১৯৯০ সালে ৩১ শতাংশ হ্রাস পায়। একইভাবে ২০০২ সালে চলনবিলে ৫৪ শতাংশ মাছ হ্রাস পায়। তারপর থেকেই বিলটির প্রায় ৭৫ শতাংশ জলাশয় শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের হিসেব অনুসারে, চলনবিলে উল্লেখিত সংখ্যক স্থায়ী ও প্লাবনভূমি জলাশয় ছাড়াও প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর পুকুর এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেচ নালা এলাকা রয়েছে।
তাই এখনো প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে মাছধরা পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। তারা নেমে পড়েন ভাগ্য অন্বেষণের কাজে। চলনবিল তার বর্তমান অবস্থাটুকুও আর কতোদিন ধরে রাখতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
এমবিএইচ/এএসআর
** জলাধারের বুকে হলুদ-সবুজের খেলা!
** অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে বিপন্ন বিশাল জলরাশি