সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বড় মহারাজপুর গ্রামের কৃষি দিনমজুর জালাল। অন্যের জমিতে কাজ করতেন।
ঢাকায় গার্মেন্টসে কর্মরত ছোট ভাই হেলালের একমাত্র ছেলের সুন্নতে খাৎনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পরিবারের অন্য ১৮ সদস্যের সঙ্গে মঙ্গলবার রওনা হয়েছিলেন জালাল। অনুষ্ঠানটি ছিল দরিদ্র এ পরিবারটির এক মিলনমেলা।
শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নসিমনে চেপে তারা উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশনে যাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল উল্লাপাড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় যাওয়া।
কিন্তু কে জানতো তাদের পরিবারের এ মিলন মেলাটি বিষাদময় করে তুলবে একটি ঘাতক ট্যাংকলরি। বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কের গাড়াদহ নামক স্থানে তাদের নসিমনটি পৌঁছালে তেলবাহী একটি ট্যাংকলরির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ওই পরিবারের সাত সদস্য। আশঙ্কাজনক অবস্থায় বগুড়া নেওয়ার পথে মারা যান আরও একজন। এ দুর্ঘটনায় আহত হন ওই পরিবারেরই নারী ও শিশুসহ আরো নয়জন। এভাবেই আনন্দঘন মুহূর্তটিকে একটি কালো আঁধার এসে ঢেকে দিয়ে গেল।
দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান জালাল ও তার স্ত্রী অঞ্জনা। তবে অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় তাদের দুই শিশু সন্তান চয়ন (৮) ও খোকা (৫)। গুরুত্বর আহতবস্থায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে তারা।
এ দুর্ঘটনায় আরও যারা প্রাণ হারিয়ছেন তারা হলেন, জালালের ভাই মকবুল (৪৭), আরেক ভাই আকবর আলীর স্ত্রী রেনু খাতুন (৪৫), ছোট ভাই তারা মিয়ার স্ত্রী পূর্ণি খাতুন (২৬), বড় ভাইয়ের ছেলে রেজাউলের স্ত্রী ফিরোজা খাতুন (২০), অপর ভাতিজা রজব আলীর শিশুকন্যা বন্যা (৯) এবং চাচী মৃত সুরমান আলীর স্ত্রী ওজুফা (৬০)।
মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে বড় মহারাজপুর গ্রামে গেলে দেখা যায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। প্রতিবেশী ও আশপাশের গ্রাম থেকে দেখতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। নিহতদের পরিবারের জীবিত সদস্যদের মধ্যে বেশিরভাগই আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বাড়ির উঠোনে বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন নিহত জালালের ছোট ভাই ফিরোজ, ভাতিজা হোসেন আলী, অপর ভাতিজা রজব আলীর স্ত্রী মাজেদা খাতুন। হাজার হাজার মানুষ দেখতে আসলেও তারা যেন শান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
প্রতিবেশী আফসার আলী, ফকরুল ইসলাম, ময়নাল মোল্লাসহ অনেকেই জানান, এ পরিবারের সবাই ছিল দিনমজুর। অনেক কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তাদের মধ্যে ছিল পারিবারিক ভালোবাসার এক অটুট বন্ধন। এ পরিবারের অনেক উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে চরম অনিশ্চয়তার মধ্য পড়লো বাকী সদস্যরা। বিশেষ করে গুরুত্বর আহতদের চিকিৎসার ব্যয় কে বহন করবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
নিহত জালালের নিকটাত্মীয় পার্শ্ববর্তী রতনকান্দি গ্রামের আব্দুল মান্নান জানান, জালাল ও তার স্ত্রী মারা যাওয়ায় তাদের আহত দুই শিশু সন্তানকে দেখার আর কেউ রইল না। অল্প বয়সে এতিম হয়ে যাওয়া এ শিশু দু’টির ভবিষ্যত জীবন অনিশ্চয়তার মধ্য পড়ে গেল।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম আহম্মেদ বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত প্রতি পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা ও শাহজাদপুর ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার করে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও আহতদের চিকিৎসার জন্য পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, একই পরিবারের সদস্যরা মারা যাওয়ায় ওই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পুনর্বাসনে উপজেলা প্রশাসন সর্বাত্বক ব্যবস্থা নেবে। এছাড়াও বাবা-মার মৃত্যুতে এতিম হওয়া শিশুদের দায়িত্বও আমরা নিতে চাই।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
আরএ