ঢাকা: চুক্তিতে পার্কের ৬ হাজার ৯শ’ দশমিক ২৫ বর্গফুট জায়গা ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু একটি রেস্তোরাঁ ব্যবহার করছে এর বাইরে আরও প্রায় ছয়গুণ বেশি জায়গা।
রাজধানীর রমনা পার্ক রেস্তোরাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ইউরো আসিয়ানো’ এ অনিয়ম করে গেলেও গণপূর্ত অধিদফতরের নজরদারি নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় ৪২ হাজার বর্গফুট জায়গা ব্যবহার করছে রেস্তোরাঁটি। ফলে চুক্তির বাইরেও প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুট বেশি জায়গা ব্যবহার করা হচ্ছে। অবশ্য সামনের ১৬ হাজার ৩৩০ বর্গফুট জায়গা পার্কের দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে চুক্তিতে। এ হিসেবেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি পার্কের আরও প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট জায়গা রেস্তোরাঁর কাজে ব্যবহার করছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, ইউরো আসিয়ানোর স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন আহমেদ ঝিলু সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় এ অপকর্মের প্রতিকার হচ্ছে না। গত মহাজোট সরকারের শুরুতে প্রতিমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে রমনা পার্ক রেস্তোরাঁর ঠিকাদারি কাজটি পেয়েছেন তিনি।
ঠিকাদারি কাজটি পেতে আগ্রহী সরকারি দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী অভিযোগ করেছেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে লিজ দেওয়া হলেও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মান্নানের হস্তক্ষেপে তারা কাজটিতে ভিড়তেই পারেননি। তাই চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েও হুমকি-ধামকির মুখে পিছু হটতে বাধ্য হন তারা। এরপর সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে বিনা বাধায় কাজ পেয়ে যায় ইউরো আসিয়ানো।
তারা ওই সময় নিয়ম-কানুনের মধ্যে চেষ্টা করেও প্রতিমন্ত্রীর কারণেই রমনা রেস্তোরাঁর ঠিকাদারি কাজটি পেতে ব্যর্থ হন বলেও অভিযোগ তুলেছেন ওই নেতাকর্মীরা।
গণপূর্ত অধিদফতর সূত্র জানায়, কয়েকজন যুবলীগ নেতা রমনা রেস্তোরাঁর ঠিকাদারি কাজ পেতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শুরু থেকেই প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান ইউরো আসিয়ানোর স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন আহমেদ ঝিলুকেই কাজটি পাইয়ে দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। তাই এ প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরাও বিষয়টি স্বীকার করে জানান, খাতা-কলমে প্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রমাণ করা না গেলেও একটি ঘটনায় তিনি ফেঁসে যেতে পারেন। আর তা হল সর্বোচ্চ দরদাতা রেখে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়া। প্রয়োজন ছিল পুনরায় দরপত্র আহবান করা। কিন্তু তা করা হয়নি। তারা বলেন, নানারকম হয়রানি আর ঝামেলা এড়াতে সরে আসেন সর্বোচ্চ দরদাতারা।
অন্যদিকে কাজটি পেয়েও চুক্তি মানছেন না ইউরো আসিয়ানোর স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন আহমেদ ঝিলু। চুক্তি অনুসারে প্রতিষ্ঠানটির ৬ হাজার ৯শ’ দশমিক ২৫ বর্গফুট জায়গা ব্যবহার করার কথা। অথচ সরেজমিনে দেখা গেছে, নির্ধারিত এ জায়গার চেয়েও প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুট বেশি অর্থাৎ মোট প্রায় ৪২ হাজার বর্গফুট জায়গা ব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠানটি।
রেস্তোরাঁটির কর্মচারীরা জানান, এখানে ৫ হাজার লোকের আয়োজন করার সামর্থ্য আছে। এজন্য প্রায় ৪২ হাজার বর্গফুট জায়গা ব্যবহার করা হয়।
গণপূর্ত অধিদফতরের সূত্র জানায়, ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা পরিশোধের শর্তে রমনা পার্ক রেস্তোরাঁটি ইউরো আসিয়ানো রেস্টুরেন্ট পাঁচ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ২০১২ সালের ১২ আগস্ট গণপূর্ত অধিদফতরের সঙ্গে ইউরো আসিয়ানোর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৭ সালের ১১ আগস্ট পর্যন্ত এ চুক্তি কার্যকর থাকবে। তবে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করলে তা বাতিল করার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
চুক্তির শর্ত অনুসারে রমনা পার্কের ভেতরের আচ্ছাদিত ৬ হাজার ৯০০ দশমিক ২৫ বর্গফুট এলাকা রেস্টুরেন্টের কাজে ব্যবহার করতে পারবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চুক্তিতে এ ব্যাপারে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, এ বরাদ্দের মূল স্ট্রাকচার ৪ হাজার ৮৯৫ দশমিক ২৫ বর্গফুট, বারান্দা ৯৬০ বর্গফুট, রান্নাঘর ৫২৮ বর্গফুট, টয়লেট ১১৩ বর্গফুট ও আধাপাকা শেড ৪০৪ বর্গফুট।
রেস্টুরেন্টের সামনের ১৬ হাজার ৩৩০ বর্গফুট জায়গা পার্কের দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখার কথাও বলা হয়েছে চুক্তিতে। এর বাইরে আর কোনো জায়গা ব্যবহারেরও কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি চুক্তিতে। অথচ চুক্তি লঙ্ঘন করে আরও প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট পার্কের জায়গা রেস্টুরেন্টের কাজে ব্যবহার করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
চুক্তি লঙ্ঘন করে বেশি জায়গা ব্যবহার করায় ঐতিহাসিক রমনা পার্কের সবুজ ঘাস, পত্র-পল্লব এবং গাছপালা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া খাবারের বেশি দাম রাখাসহ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ক্রেতাদের জিম্মি করে ব্যবসা করারও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত রমনা রেস্তোরাঁটি খোলা থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে আরও বেশি সময়ও খোলা রাখা হয়। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার ভোর ছয়টা থেকে খোলা হয় রেস্তোরাঁ। এছাড়া অন্যান্য ছুটির দিনও একই সময়ে খোলা হয়।
গ্রাহকদের অভিযোগ, টোকেন কেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও খাবার না পেয়ে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে বাধ্য হন অনেকে। অন্যান্য রেস্টুরেন্টের তুলনায় এখানকার খাবারের দাম তিনগুণ বেশি রাখা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
প্রকাশ্যে এসব অনিয়ম চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি পার্কে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরাও।
অভিযোগ উঠেছে, বিগত মহাজোট সরকারের প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানের কিছু ঘনিষ্ঠজন এখনও গণপূর্ত অধিদফতরের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তারাই চুক্তি লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠান ইউরো আসিয়ানোকে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। এ কারণে চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়ে তারা মাথা ঘামান না। অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে গণপূর্তের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মাসোহারা নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। মাসোহারা ছাড়াও বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করেও তাদেরকে ম্যানেজ করে রাখছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
এএসআর