ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘আমরা তুচ্ছ নাগরিক’

তাবারুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৫
‘আমরা তুচ্ছ নাগরিক’ ছবি: রাজীব /বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ‘আমরা এদেশেরই নাগরিক, কিন্তু আমরা হলাম তুচ্ছ নাগরিক। আমাদের নিয়ে কারও কোনো ভাবনা নেই।

ভোটের দরকার হলে আমাদের কাছে অনেকেই আসে। এরপর আমাদের দুর্দিনে আর কেউ এগিয়ে আসে না। ’

সোমবার (২১ ডিসেম্বর) দিনগত রাত ১২টায় ভাঙা ঘর ও এলোমেলো আসবাবপত্রের পাশে বসে এভাবেই দুঃখ করে কথাগুলো বলছিলেন উচ্ছেদ হওয়া রাজধানীর মিরপুরের বাগানবাড়ি বস্তির বাসিন্দা মো. আজিজুল।

আজিজুলের বাড়ি ভোলা জেলায়। মা, বাবা ও স্ত্রীকে নিয়ে এই বস্তিতে গত ১০ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন তিনি।

সকালে সেখানে অভিযান চালিয়ে বস্তি উচ্ছেদ করে প্রশাসন। আজিজুলের দাবি, মাত্র একদিন আগে রোববার (২০ ডিসেম্বর) রাতে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বস্তি ভাঙার ঘোষণা দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, বস্তি থেকে আমাদের জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময়টুকুও দেওয়া হয়নি। সকালে পুলিশ ও সরকারের লোকজন এসে এসব উচ্ছেদ করে। এ সময় আমাদের কোনো কথা তারা শোনেনি, জিনিসপত্রও রক্ষা করার সুযোগ দেয়নি।

ভাঙা বস্তিতে খড়কুটো দিয়ে জ্বালানো আগুনের আলোর পাশে বসে আজিজুল বলেন, দুই দিন আগে মা-বাবা দেশে চলে গেছেন। আমি ও আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আছি। এই অবস্থায় স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় আশ্রয় নেবো, তা-ও ভেবে পারছি না।

সরেজমিনে দেখা যায়, অভিযানে টিন ও কাঠের তৈরি কয়েক’শ ঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাঙা জিনিসপত্র পাশের নালার ওপর ফেলে রাখা হয়েছে। এলোমেলো জিনিসপত্রের ফাঁকে খোলা আকাশের নিচে বস্তির বহু বাসিন্দা জেগে ও ঘুমিয়ে আছেন। কেউ কেউ আলো জ্বালিয়ে শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। বস্তি ভেঙে নালার এক পাশে নতুন ঢেউটিন দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে।

মিরপুর ১৪ নম্বরের সিএনজি স্টেশন থেকে নালার পাশ দিয়ে সরু গলি দিয়ে মিনিট দু’এক হাঁটলেই বাগানবাড়ি বস্তি। বস্তিতে প্রবেশ করতে দেখা যায় দু’জন নারী আলো জ্বালিয়ে একটি চৌকিতে বসে আছেন। চৌকিতে দুই শিশুও শুয়ে আছে।

নারীদের একজন মনিকা ও অপরজন শাহিনা। তারা জানান, এই বস্তিতে ১০ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। হঠাৎ করে গতরাতে মেইন সড়কে এই বস্তি ভাঙার বিষয়ে মাইকিং করা হয়। ঘর-আসবাবপত্র ভেঙে উচ্ছেদের বিষয়ে তাদের কাছে কেউ কোনো নোটিশ নিয়ে আসেনি। কিন্তু সকালে সরকারের লোকজন এসে ভাঙচুর করে। এখন এই শীতে কোথায় আশ্রয় নেবেন, এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তারা।

মনিকা ও শাহিনা বলেন, আমাদের যদি চলতি মাস সময় দেওয়া হতো তাহলে জিনিসপত্র নিয়ে নতুন কোনো জায়গায় ভাড়ায় চলে যেতাম। কিন্তু জিনিপত্রের যে অবস্থা হয়েছে তা আর ব্যবহার করা যাবে না।

শাহিনা বলেন, আমার মেয়ে সাদিয়া হাজী সাহাবউদ্দীন প্রি-ক্যাডেট স্কুলে নার্সারিতে পড়ে, ওর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। এখন যে অবস্থায় পড়েছি এতে মনে হয় গ্রামে চলে যেতে হবে। কিন্তু গ্রামে তো কাজ নাই, স্বামী রিকশা চালায়। গ্রামে গিয়ে আমরা কী করবো?

বস্তির আরেক ফাঁকে ভাঙা আসবাবপত্রের পাশে আগুন জ্বালিয়ে শুয়ে ছিলেন আজমত আলী। তিনি জানান, ১৯৮৩ সালে তিনিসহ কয়েকজন সেখানে বস্তিঘর তৈরি শুরু করেন। ওই সময় থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বস্তা দিয়ে বালি, মাটি ও ইট এনে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এখন বিনা নোটিশে সব কিছু একদিনে ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

বস্তিতে শত শত লোকজন বসবাস করতো জানিয়ে তিনি বলেন, শীতের রাতে এই মানুষগুলো যে যার মতো রাস্তা, বাসস্ট্যান্ড ও ‍আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে। অনেকে নিরুপায় হয়ে শীত উপক্ষো করে বস্তিতে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে।

বস্তির একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, রোববার রাতে বস্তি ভাঙার খবর পেয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর জামাল মোস্তফার কাছে যান বাসিন্দারা। কাউন্সিলরের মাধ্যমে বস্তি ভাঙার ক্ষেত্রে সরকারের কাছে আরও কয়েকটি দিন সময় চান তারা। কিন্তু তিনি (কাউন্সিলর) বস্তিবাসীদের জন্য কিছু করেননি।

বস্তির ২৭ কাঠা জায়গা পাশের মার্ক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নামে বরাদ্দ দিয়েছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। সোমবার সকালে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এই উচ্ছেদ অভিযান চালায়। মঙ্গলবারও এই বস্তি এলাকায় আরও ঘর উচ্ছেদ চালানো হতে পারে বলে শঙ্কায় আছেন এখানকার বাসিন্দারা।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৫
টিএইচ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।