ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ধানের ফলনে কৃষকের হাসি, দামে বেজার

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৫
ধানের ফলনে কৃষকের হাসি, দামে বেজার ছবি: মানজারুল ইসলাম/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনার দাকোপ থেকে ফিরে: কৃষক তো আর ধান ফলাতেই চান না। ফলন ভালো হলে কি হবে? ধানের দাম যা মেলে, তাতে চাষের খরচই ওঠে না।

জমি-জিরেত নিয়ে বড়ই বিপাকে গ্রাম-গঞ্জের গৃহস্থ পরিবারগুলো। চাষের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বর্গা চাষীরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

এ অবস্থায় নিজেদের খোরাকির জন্য প্রয়োজনীয় ধানটুকু ফলিয়ে নিয়ে বাকি জমি অনাবাদি ফেলে রাখাই সাব্যস্ত করতে চান চাষিরা।
তাদের মতে, এমন ধারা চলতে থাকলে জমিতে চাষ পড়বে না। অনাবাদী থেকে যাবে অনেক জমিই।

তাদের দাবি, সরকার ধানের মণ অন্তত ৮০০ টাকা করে দিলে কৃষকরা বাঁচতে পারেন। বর্তমানে যা মাত্র ৪৫০ টাকা।

কেবল খোরাকির ধান ফলিয়ে নিলেতো হবে না, কৃষকের সংসারের অন্য খরচও আসে ধান বিক্রির টাকায়। কৃষক পরিবারের পুষ্টি, চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, আনন্দ-বিনোদন সবকিছুই এই ধাননির্ভর। চাষের খরচ যদি বিক্রিমূল্যের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তাহলে থমকে যাবে লাখো-হাজার কৃষক পরিবারের জীবন।

খুলনা নগরী পার হয়ে সুন্দরবনের দিকে যেতে পড়ে দুই উপজেলা বটিয়াঘাটা আর দাকোপ। উপজেলা দু’টির বুক চিরে পশুর নদীর পাশ ঘেঁষে টানা ৩০ কিলোমিটার পিচঢালা পাকা সড়ক ধরে যেতে একদিকে নদী আর অন্যদিকে বড় বড় ধানের জোত চোখে পড়ে। তাতে ধান পেকেছে। কৃষকরা ধান কাটায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে এখানে সেখানে গ্রামগুলোতে বসতি এই চাষিদের। মাঠ থেকে ধান কেটে অনেকেই পাকা রাস্তায় তুলছেন, সেখান থেকে ভটভটি (যন্ত্রচালিত ভ্যানগাড়ি বিশেষ) ভরে ধান নেওয়া হবে বাড়িতে। সেখানে মাড়াই হবে। চাষির গোলা ভরবে ধানে।

আরও পরে সরকারের পক্ষ থেকে যখন কেনা হবে ধান আর চাল তখন চাষিরা তা বিক্রি করবেন। নগদ টাকায় চলবে তাদের ভাতের খোরাকি ছাড়া বাদ বাকি জীবন খরচ। গোটা বছরের সম্বল-পুঁজি তাই এই ধান।

শুক্রবার (২৫ ডিসেম্বর) বেলা ১২টা নাগাদ তেমনই একটি ভটভটিতে ধান বোঝাই হচ্ছিলো চালনা থেকে পানখালীর পথে পাকা সড়কের পাশে। কামলারা বড় বড় ধানের বোঝা বয়ে রাস্তায় তুলছিলেন। আর তা খুলে ছোট ছোট আঁটিগুলো থরে থরে সাজিয়ে ভটভটি বোঝাই করতে ব্যস্ত অন্য দু’জন। একেকটি আঁটিতে তিন কেজি পরিমাণ ধান হবে এমন একটা মাপে বাঁধা। সবাই কাজে ব্যস্ত। দিনে দিনে অনেক কাজই সারতে হবে।

অল্পক্ষণ পরে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে পাকা সড়কে উঠলেন আবদুস ছত্তার। তারই ধান। তিনিই কৃষক। গৃহস্থ ঘরের চাষি।

২৫ বিঘা জমিতে ধান ফলিয়েছেন। ফলন কেমন? সে প্রশ্নে মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, ‘মাশাল্লাহ ভালো!’

সব ধানই খোরাকিতে লাগবে? আবারও হাসি ছড়িয়ে পড়লো কৃষকের মুখে। ‘কী যে বলেন, খোরাকের জন্য ৫০ মণ ধানই যথেষ্ট। ৫০০ মণ ধান হবে। বাকিটা বিক্রি করবো’।

এবার বেজার মুখ ছত্তার চাষির। বললেন, ‘ধানের মণ বিকোচ্ছে মোটে ৪৫০ টাকা। আর আমাদের মণপ্রতি ধান উৎপাদনেই খরচ লাগিছে ৫০০ টাকা। এই হলি কি কৃষক বাঁচবি?’

কতো করে মণ হলে ভালো হয়? সে প্রশ্নে বললেন, ‘অন্তত ৮০০ টাকা মণ হলি কৃষক ধান ফলায়ে শান্তি পাবি। তা না হলি একদিন ধান ফলানো বন্ধ করি দিতি হবি আমাগের। ’

বিপদের কথা, কৃষক ধান ফলানো বন্ধ করে দিলে দেশের মানুষ খাবে কি? বাংলানিউজের এ উদ্বেগের উক্তিতে পাশের আরেক চাষি শাহাদৎ ‍বললেন, ‘আমরা কী করবো? জমি নিয়ে এখন বিপদে পড়িছি। ধানের দাম ওঠে না বলি কেউ বর্গা চাষ দিতেও চায় না। ’

শাহাদৎ জানালেন, তাদের ৮০ বিঘা জমি রয়েছে, তার অনেক জমি এ বছরই অনাবাদি থেকে গেছে।

‘এতো জমিতে ধান ফলিয়ে আমরা কী করবো, খোরাকিতে লাগবি আর কটা ধান? চাষের খরচ না উঠলি আমরা চাষ দিয়ে কি পথে বসবো নাকি?’

খরচ কেনো এতো বেশি? সে প্রশ্নে বিঘাপ্রতি ধান চাষে খরচের কাটায় কাটায় একটা হিসাব দিলেন ছত্তার চাষি। বললেন, ‘ধান ফলাতে একটি জমি তিনটি চাষ দিতে হয়। এতে খরচ প্রায় ২০০০ টাকা। বীজ ধানের পেছনে যাবে ৫০০ টাকা। এতে বীজ তৈরি হয়ে রোপণের উপযোগী হবে। চারা লাগানোর পর সার-ওষুধ ছিটাতে যায় আরও ৫০০ টাকা। চারাটা চার আঙুল-ছয় আঙুল হয়ে উঠলে নিড়ানি দিতে হয়, আরেক দফা সার দিতে হয়। এতে কামলা খরচসহ আরও প্রায় ১৫০০ টাকা পড়ে। সব মিলিয়ে চাষেই খরচ হয় প্রতি বিঘায় ৫০০০ টাকা’।  

এরপর ধান পাকলে তা কাটা, বাড়িতে তোলায় রয়েছে আরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ। তারও একটি হিসাব দিলেন আবদুস ছত্তার। জানালেন, ‘এক বিঘা জমিতে ধান কাটতে দুই দিন তিনজন করে মোট ছয় জন কামলা লাগে। যাদের মাথাপিছু মজুরি ৩০০ টাকা করে মোট ১৮০০ টাকা। আর দুইবেলা করে মোট ১২ বেলা খাবার খরচ আরও অন্তত ১৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে ধান কাটার পর্যায়ে খরচ আছে ৩৫০০ টাকা’।

এরপর থাকে ধান মাড়াইয়ের খরচ। বিশ মণ ধান মাড়াইয়ে অন্তত ১৫০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে এক বিঘা জমির ধান বিক্রির জন্য পুরো প্রস্তুত করতে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা।

এ বছর ফলন ভালো হওয়ায় এক বিঘা জমিতে ধান হয়েছে প্রায় ২২ মণ করে। তা বিক্রি করা যাবে বর্তমান দরে ৯৯০০ টাকায়।

মুখে কষ্টের হাসি ছড়িয়ে ছত্তার চাষি বললেন, ‘এতো কষ্ট করে বিঘায় ১০০ টাকা লাভ! আর আমার নিজের গতর খাটার হিসাবটাতো কেউ করবে না’।  

চালনার এই এলাকায় ৯০ শতাংশ গৃহস্থ ঘর নিজেরাই জমি চাষ করে, বাকি দশ শতাংশ বর্গা চাষি।

‘এখন বর্গা কেউ নিতে চায় না, যে নেয় সেই বিপদে পড়ে। বর্গা নিলে তাগের গাইটেতেই যায়’- বলেন শাহাদৎ।

শুধু চাষি কেনো? ক্ষোভ ক্ষেতমজুরদেরও। এ কথাই বলতে এগিয়ে এলেন ধান কাটায় যারা কামলা খাটছিলেন তাদেরই একজন। ততোক্ষণে ভ্যান বোঝাই হয়ে গেছে ধানে।

বললেন, ‘ভাই আমরাও শেষ। আমরাও শ্রমের ন্যয্যমূল্য পাচ্ছিনে’।

সে কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে সোবহান নামে পঞ্চাশোর্ধ ওই ক্ষেতমজুর জানালেন, ধানের দামের হিসাবেই তাদের শ্রমের দাম। এই শ্রমিকরা একেক বিঘা ধান কেটে গৃহস্থের বাড়িতে তুলে দেওয়ার ঠিকা নেন। তাতে বিঘাপ্রতি তাদের দিতে হয় দুই মণ ধান। দাম কম হওয়ায় তাদের শ্রমের ন্যায্যমূল্য মিলছে না।

এই যদি হয় দশা তাহলে ধানের দাম কতো হলে ভালো হয়? উত্তরে ছত্তার ও শাহাদৎ চাষির দাবি- ‘অন্তত ৮০০ টাকা করে মণ হলে কৃষক ধান ফলায়ে শান্তি পাবে’।

কিন্তু তাতে তো চালের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষ কিনে খেতে পারবে না?

‘সে হিসাব সরকারের। একদিকে লাভ করতে গিয়ে আরেক দিকে ক্ষতিতো সরকার করতি পারে না। কৃষকের মাথায় হাত পড়ি গেছে!’- বললেন ছত্তার চাষি।

‘এবার ধানের দাম না বাড়লি আগামী বছর আর চাষই করবো না,’ ঘোষণা তার।

তবে শাহাদৎ একটা হিসাব দিলেন, ‘এক মণ ধানে ৩০ কেজি চাল হবে। কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা বিক্রি হলে তার দাম পড়বে ১০৫০ টাকা। আমরা কৃষকরা ৪৫০ টাকা পালি বাকি ৬০০ টাকা কে পাবি? তাগের ভাগে কম ফালায়ে আমাদের খরচার টাকা উঠে, এমন একটা দর দিলেই হবে। কৃষকতো আর নিজে গচ্চ্ দিয়ে দেশের কোটি মানুষের মুখে ভাত তুলতি যাবি না’- বললেন তিনি।

কৃষকের এ প্রশ্নের ও আক্ষেপের উত্তর মিলেছে সরকারের সাম্প্রতিক এক উদ্যোগে। হয়তো একটি সমাধানও তাতে আসবে। বাংলানিউজের সিনিয়র স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট সুকুমার সরকার তার রোববারের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তাতে বলা হয়েছে-

‘ধান-চাল ক্রয়ে কৃষককে সরকার নির্ধারিত মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত এবং মধ্যসত্ত্বভোগীর হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে খাদ্য সংগ্রহ পদ্ধতির ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ‘লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (এলআইসিটি)’ প্রকল্প খাদ্য অধিদফতরের খাদ্য সংগ্রহ পদ্ধতির ডিজিটালাইজেশন করতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ংকে নিয়োগ দিয়েছে।

আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে এবং আগামী ছয়মাসের মধ্যে খাদ্য অধিদফতরের খাদ্য সংগ্রহ পদ্ধতির ডিজিটালাইজেশনের সফটওয়্যার চালিত অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করবে’।

‘এ অ্যাপ্লিকেশনটিতে কৃষকদের অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, তাদের উৎপাদিত ধানের পরিমাণের তথ্য এবং কৃষককে অনলাইনে ও মোবাইল ফোন এসএমএসের মাধ্যমে ধান কেনার তথ্য ও নিয়ম-নীতিগুলো জানানো হবে’।

‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকও এ নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সরকার ধান ক্রয়ে মধ্যসত্ত্বভোগীর হস্তক্ষেপ বন্ধ করে কৃষকদের প্রতি কেজি ধান বা চালের সরকার নির্ধারিত মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে খাদ্য সংগ্রহের সনাতন পদ্ধতিকে ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে’।

মাঝের ৬০০ টাকা কে পাবি? বলে ছত্তার ও শাহাদৎ নামের প্রান্তিক দুই চাষির প্রশ্নের উত্তর তাতে মিলবে বলেই আশা করা যাচ্ছে। আর তাতে ফসল ফলিয়ে কৃষকের মুখে শুধু হাসিই ফুটে থাকবে- এটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৫
এমএমকে/এএসআর   

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।